বইমেলায় নানাভাবে বাড়ছে প্রচার মাধ্যমের মুখরতা
বইমেলায় নানাভাবে বাড়ছে গণমাধ্যমের তৎপরতা। আজ থেকে দেড় দশক আগে মেলায় দেখা মিলত শুধু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভির ক্যামেরা, আর হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক। এই দীর্ঘ সময়ে মেলার পরিসর যেমন বেড়েছে, তেমনি বিকশিত হয়েছে গণমাধ্যম। কালের যাত্রার সঙ্গী হয়েছে বৃহৎ পুঁজির বেশ কয়েকটি পত্রিকা এবং প্রায় ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল।
গত কয়েক বছর ধরে মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ক্যামেরা হাতে চষে বেড়াচ্ছেন এসব টিভি সাংবাদিক ও পত্রিকার সাংবাদিকরা। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল বিকেলে মেলা চত্বর থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আর পত্রিকায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে বইমেলা নিয়ে নানারকম প্রতিবেদন। বইমেলায় পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম।
অন্যদিকে নানা স্তরের এই গণমাধ্যমকর্মীরা শুধু মেলার খরব প্রকাশের মাঝেই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেননি, তারা মেলায় নিয়ে আসছেন নানা ধরনের সৃজনশীল ও মননশীল বই। এ ক্ষেত্রে বিষয় নির্ধারণে অনেকে বেছে নিচ্ছেন খোদ ‘গণমাধ্যম’কেই। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে মেলায় এসেছে বেশ কয়েকটি বই।
অমর একুশে বইমেলার ষষ্ঠ দিন গতকাল সোমবার (০৬ ফেব্রুয়ারি) মেলায় নতুন বই এসেছে মোট ৯০টি এবং আটটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। নতুন আসা বইয়ের মধ্যে গল্প ১৪টি, উপন্যাস ১১টি, প্রবন্ধ ১০টি, কবিতা ২২টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ৪টি, জীবনী ২টি, রচনাবলি ১টি, মুক্তিযুদ্ধ ১টি, বিজ্ঞান ৫টি, ভ্রমণ ২টি, ইতিহাস ২টি, স্বাস্থ্য ৩টি, কম্পিউটার ১টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি ও অন্যান্য ৯টি।
মহাখালী থেকে বাংলা বইমেলায় ঘুরতে এসেছেন রাজু বড়ুয়া। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কথা হয় রাজু বড়ুয়ার সঙ্গে। বইমেলায় ঘুরতে আসা প্রসঙ্গে রাজু বড়ুয়া বলেন, বইমেলা বাঙালির মিলনমেলা। মানুষ বইমেলায় শুধু বই কিনতেই আসে না, শত ব্যস্ততার মাঝে একটু বিনোদন নিতেও অনেকে বইমেলায় আসেন। রাজধানীর উত্তরা থেকে স্ত্রী নাদিয়া বেগম, দুই ছেলে নাফিজ আহসান ও নাবিল আহসানকে নিয়ে বইমেলায় আসেন আসাদুজ্জামান। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সামনে ছেলেদের জন্য বই কিনছিলেন আসাদুজ্জামান। বইমেলা নিয়ে কথা হয় আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। আসাদুজ্জামান বলেন, প্রতিবছরই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বইমেলায় আসি। মেলায় ঘুরতে আসা। ছেলেমেয়েদের পছন্দমতো বইও কিনে দিই। পাশাপাশি সবাই মিলে বইমেলার আনন্দ উপভোগ করি।
এবারের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা নির্বাচিত প্রবন্ধ বের হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। বইগুলো হলো- ‘সহে না মানবতার অবমাননা’, ‘শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র’, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা’ ইত্যাদি। বাংলা একাডেমির যুব জাগরণ স্টলের বিক্রয়কর্মী মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের স্টলে দুটি বই বেশি বিক্রি হয়। একটি হলো- শেখ হাসিনার নির্বাচিত প্রবন্ধ, অন্যটি হলো- মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরীর লেখা জনগণের ক্ষমতায়ন উন্নয়নের জাগরণ। আগামী প্রকাশনী থেকে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রবন্ধের বই ‘শিক্ষানীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পাকিস্তান’, রফিকুল ইসলামের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এবং ড. চিত্তরঞ্জন দাসের উপন্যাস ‘বিজয়িনী’।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২০১২ সাল থেকে স্টল দিয়ে আসছে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ’। কথা হয় স্টলের সাব-ইন্সপেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের স্টলে এ পর্যন্ত প্রায় ২০টি নতুন বই এসেছে। আমার নিজের চারটি বই বের হয়েছে এ বছর একুশে বইমেলায়। এ ছাড়া আমাদের স্টলের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহিদুল হকের লেখা ‘সমাজে পুলিশ এবং কমিউনিটি পুলিশিং’, স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত ডিআইজি তওফিক চৌধুরীর লেখা ‘আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছো’ ইত্যাদি। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পুলিশের স্টল দেয়ার অর্থ হলো মানুষের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের উন্নয়ন, যাতে সাধারণ মানুষ আর পুলিশের মধ্যে দূরত্ব না থাকে।
গতকাল বিকেল ৪টায় গ্র্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার অভিধান: দেড়শোতম জন্মবর্ষের স্মরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক আহমদ কবির, অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক ও হাকিম আরিফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ড. গোলাম মুরশিদ।
প্রাবন্ধিক বলেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য কীর্তি বঙ্গীয় শব্দকোষ। তিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের লিখিত শব্দভাণ্ডারকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। তার সংকলিত সংস্কৃত শব্দও বঙ্গীয়, অ-সংস্কৃত শব্দও বঙ্গীয়। বঙ্গদেশে প্রচলিত ও লিখিত রূপে প্রাপ্ত যাবতীয় শব্দ নিয়ে তিনি অভিধান রচনা করতে চেয়েছিলেন। সফলতার সঙ্গে তা তিনি সম্পন্নও করেছেন। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের নিকট হরিচরণের অভিধান ততদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আলোচকবৃন্দ বলেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্র্রদর্শিত পথে বাংলা একাডেমি ষাটের দশকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ থেকে সম্প্রতি গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ প্রণয়ন ও প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। একাডেমি এসব অভিধানকে সম্পূর্ণ আর হালনাগাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেড়শোতম জন্ম বছরের এই আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ হবে। সভাপতির বক্তব্যে ড. গোলাম মুরশিদ বলেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণের তাৎপর্য অপরিসীম। তার অভিধান-অন্বেষা যেমন বঙ্গীয় শব্দকোষের মতো মহার্ঘ্য অভিধান আমাদের উপহার দিয়েছে তেমনি উত্তরকালের গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা রেখে গেছে।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ফাতেমা তুুজ-জোহরা, সুজিত মোস্তফা, ইয়াসমিন মুশতারী ও এ কে এম শহীদ কবীর পলাশ। যন্ত্রাণুুষঙ্গে ছিলেন বিশ্বজিৎ সরকার (তবলা), বিদ্যুৎ রায় (প্যাড), সুনীল কুমার সরকার (কি-বোর্ড) এবং ফিরোজ খান (সেতার)।
মন্তব্য চালু নেই