বিশ্লেষণ: নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই

কামাল আহমেদ : অনুসন্ধান কমিটিকে রাষ্ট্রপতি ১০ জনের নাম সুপারিশ করার জন্য যে সময় দিয়েছিলেন, তা শেষ হওয়ার দুদিন আগেই আমরা নতুন নির্বাচন কমিশন পেয়ে গেলাম। অস্বাভাবিক দ্রুততায় নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর চারজন কমিশনারের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করলেন এবং তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে গেছে। রকিব কমিশন বিদায় হওয়ার আগেই তাঁদের উত্তরসূরিরা প্রস্তুত এবং তাঁদের শপথ আজ-কালের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে।

কে এম নুরুল হুদা হচ্ছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিয়েছেন এবং তাঁদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছেন যিনি, সেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমের জানানো তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পেশ করা তালিকায় কে এম নুরুল হুদার নাম ছিল না। তাহলে তাঁর নামটি কোন দলের সুপারিশে ছিল? এ প্রশ্নের জবাব কি আমরা কোনো দিন জানতে পারব?

অনুসন্ধান কমিটি এবার বেশ ঘটা করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিল। ওই বিশিষ্টজনেরা প্রায় সবাই প্রস্তাবের জন্য বাছাই করা নাম গণমাধ্যমে প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল নামগুলো আগে প্রকাশ পেলে সম্ভাব্য কমিশনারদের সম্বন্ধে সব ধরনের তথ্য আগাম জানা সম্ভব হবে। তাঁদের কারও কোনো রাজনৈতিক অতীত আছে কি না কিংবা নৈতিকতার কোনো বিষয় কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কি না, এগুলো আগে জানা সম্ভব হলে রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা কমিশন গড়তে পারবেন। স্বচ্ছতার সেই আবেদনের প্রতি অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের অনেকেরই ইতিবাচক মনোভাব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমনটি হলো না।

২০১২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের সময়েও তখনকার অনুসন্ধান কমিটি তাদের বাছাই করা ১০ জনের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। সেবারে নামগুলো প্রকাশিত হওয়ার এক দিন পর কাজী রকিবউদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজন কমিশনারকে নিয়োগ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। এবারে অবশ্য হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে আমরা শুনতে পেলাম, ‘চাঁদ উঠলে সবাই তা দেখতে পাবে। সুতরাং, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করার আগে কোনো নাম প্রকাশের প্রয়োজন নেই।’ তাঁর এই মন্তব্য কি নিতান্তই বিচ্ছিন্ন মন্তব্য, নাকি অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাব আগে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র আছে?

মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি যাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তালিকায় সাবেক বিচারক বেগম কবিতা খানম এবং বিএনপির তালিকায় সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদারের নাম ছিল। তাহলে এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে সাবেক সচিব মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ​ হোসেন চৌধুরীর নাম তবে কারা দিয়েছিলেন? যে ১০ জনের নাম কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছে, সেই তালিকার অন্য নামগুলো তাহলে কোন কোন দলের কাছ থেকে এসেছে? রাজনৈতিক দলগুলো কি এখন তাদের জমা দেওয়া তালিকাগুলো প্রকাশ করবে? নতুন কমিশনে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হলো, তাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাঁর বয়স ৭৫ বছরের বেশি। ৭৫ বছরে কর্মক্ষম থাকতে পারা বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর। কিন্তু সেই শারীরিক সামর্থ্য নির্বাচন কমিশনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বের ভার বহনের উপযুক্ত কি না, সেই প্রশ্ন একেবারে উপেক্ষণীয় নয়।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কেউই কোনো নাম প্রস্তাব করেননি। কিন্তু তাঁরা মেরুদণ্ড শক্ত—এমন একটি নির্বাচন কমিশন চেয়েছেন এবং সে জন্য বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছিল, ওই সব সুপারিশ বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হবে। সে বিষয়েও মন্ত্রিপরিষদ সচিব কিছু বলেননি। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত হোক, সেটা কি তবে সরকার চাইছে না?

অনুসন্ধান কমিটির কাজের পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখার মাধ্যমে এই অস্থায়ী ব্যবস্থার প্রতি জন-আস্থা বজায় রাখার যে দাবি উঠেছিল, তা অপূর্ণই থেকে গেল। ফলে পুরো অনুশীলনটিই একটি নাটকের মঞ্চায়ন ছিল কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।

সূত্র : প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই