সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল

ফুঁসে উঠতে পারেন ২১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী

শতভাগ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেও ২১ লাখ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিজীবীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন অষ্টম জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। বরং অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা প্রাপ্তির হিস্যা ‘সিলেকশন গ্রেড’ ও ‘টাইম স্কেল’ সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা শেষে সেটি কার্যকর হলে জিওবি ও স্বায়ত্তশাসিত মিলে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় ১৪ লাখ কর্মচারী সরাসরি এ সিদ্ধান্তের বলি হবেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। সরকারের মোট জনবলে এদের অংশিদারিত্ব প্রায় ৯ শতাংশের মতো। এর পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হবেন পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, বিজিবি, কারারক্ষী ও ফায়ার সার্ভিসের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সদস্যরা যারা প্রজাতন্ত্রের মোট জনবলের ২৪ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এর বাইরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী, বিভিন্ন অফিসের কেরানি, ড্রাইভার, পিয়ন, দারোয়ান ও নৈশপ্রহরীরাও বলি হবেন এ সিদ্ধান্তের। তবে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল হলে কর্মচারীদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কর্মকর্তারা। কারণ নির্ধারিত সময় অন্তর তাদের পদোন্নতি হয়। পাশাপাশি সুপার নিউমেরি পদ সৃষ্টির মাধ্যমেও পদায়ন করা হয়। এমনকি তাদের প্রেষণ ও লিয়েনেও অন্যত্র পদায়ন করা হয়। এসব সুবিধা কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নাই বললেই চলে।

প্রসঙ্গত, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, অধিদফতর ও পরিদফতরের আওতায় মোট ৭১ প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণীর মোট জনবল হচ্ছে ১২ লাখ ২৮ হাজার ৩৮৭ জন। আর চতুর্থ শ্রেণীর জনবল রয়েছে প্রায় প্রায় ৩ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে শুধু ওই ছয়টি মন্ত্রণালয়েই রয়েছে যথাক্রমে ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ জন এবং ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪১১ জন।

সুপারিশের প্রতিক্রিয়াতেই এখন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বঞ্চিত হওয়ার চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বেশিরভাগ চাকরিজীবীই কাজ ফেলে এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে শুরু করেছেন। সূত্রগুলোর দাবি, সংক্ষুব্ধ ও বিক্ষুব্ধরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজধানীতে সচিবালয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্র ও ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট দফতরে সংগঠিত হচ্ছেন। তারা শলাপরামর্শ করছেন এবং করণীয় পরিকল্পনা ও ছক তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর অপেক্ষা করছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য।

বর্তমানে ১৯৯১, ১৯৯৭, ২০০৫ ও ২০০৯-এর জাতীয় পে-স্কেল আদেশ অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা ছাড়া নন-গেজেটেড তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জাতীয় পে-স্কেলের ২০ থেকে ১১ গ্রেডের আওতাভুক্ত চাকরিজীবীরা ৮, ১২ ও ১৫ বছর অন্তর টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের উভয় সুবিধা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে জাতীয় পে-স্কেল নবম গ্রেডের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য ৪ বছর অন্তর সিলেকশন গ্রেড ও ৮, ১২ বছর অন্তর টাইম স্কেল সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। আর প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্যও ৪, ১০ বছর অন্তর সিলেকশন গ্রেড ও ৮, ১২ বছর অন্তর টাইম স্কেল সুবিধা রয়েছে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড- এই দুটি স্বীকৃতি সরকারি চাকরিজীবীদের পেশাগত মর্যাদা রক্ষা, আর্থিক নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এবং কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন- এ দুই সুবিধা বিলুপ্তির সুপারিশ দিয়ে এর পরিবর্তে সুপারিশকৃত বেতন গ্রেড বা স্কেলের মধ্যে টাকার অংকে দূরত্ব বাড়ানো হয়েছে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের হার বাড়িয়ে ৫-১৬ গ্রেডে ৫ ভাগ এবং ২-৪ গ্রেড বা স্কেলে ৪ ভাগ নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট চক্রবৃদ্ধি হারে প্রদানের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া নবম থেকে ১৬তম গ্রেডে ২০টি সোপান রাখা হয়েছে, যাতে কারও বেতন বৃদ্ধি থেমে না থাকে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, পে-কমিশনের সুপারিশকৃত এ ব্যবস্থাধীনে ১৫ বছর চাকরির পর একজন সরকারি চাকুরের বেতন দ্বিগুণ হবে। আর এর পাশাপাশি কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার বিবেচনায় নিয়ে জনপ্রশাসনে সংস্কার গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হলে প্রতিটি ক্যাডারে এবং ক্যাডারবহির্ভূত গ্রেড/স্কেল এমনভাবে পিরামিড বিন্যস্ত করা যাবে, যেখানে বেতন বৃদ্ধি পদোন্নতির মাধ্যমেই হবে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের প্রয়োজন হবে না। এ ব্যাপারে সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ধাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদ্যমান চাকরিবিধি ও নিয়োগবিধির আলোকে পদোন্নতি প্রদানের সুযোগ একেবারেই সীমিত। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোতে পদোন্নতির সুযোগ নেই বললেই চলে। পদোন্নতি না হওয়ায় পুরো চাকরিকাল তাদের স্বপদেই কাজ করে যেতে হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানেই তাদের যত আপত্তি। সার্বিকভাবে চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ তৈরি না করেই সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাদ দেয়া হলে তা তাদের চাকরি জীবন ও পারিবারিক জীবনকে অন্ধকারের দিকে ধাবিত করবে। সর্বোপরি দাফতরিক কার্যক্রমে গতিশীলতা নষ্ট করবে এবং গোটা প্রশাসনকে অস্থির করে তুলবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন একটি সুপারিশ জমা দিয়েছে মাত্র। সেটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে সদ্য গঠিত বেতন পর্যালোচনা কমিটি সবে এর যাচাই-বাছাই কাজ করছে। কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কারও কোনো ওজর-আপত্তি থাকলে সেটি বেতন পর্যালোচনা কমিটিতে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। সেখানেই কমিশনের সুপারিশ ও সংক্ষুব্ধের আবেদন- এ দুইয়ের যৌক্তিকতা বিবেচনা করে পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ তৈরি করা হবে। তবে তিনি একান্তই ব্যক্তিগত মতামতের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার মনে হয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবলের সংক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি একেবারে অমূলক নয়। বিষয়টি সর্বসম্মত ভেবে দেখা হবে।

এ ব্যাপারে সচিবালয়ে কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মচারী প্রায় একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা প্রায় একই সুরে বলেন, দেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গোটা দেশই উদ্বিগ্ন কখন কি হয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে এই প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবীরাই। সে ক্ষেত্রে সরকার পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বৃহৎ স্বার্থের জলাঞ্জলি দেবে বলে মনে হয় না। যদিও বা দেয়, সেটি হবে সরকারের বড় ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের বিপুলসংখ্যক বঞ্চিতদের আন্দোলন সম্পৃক্ত হয়ে গেলে তা সরকারের জন্য মোটেও শুভকর হবে না বলেও মন্তব্য করেন তারা। সূত্র: যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই