প্যানেল শিক্ষকরা নেই সরকারের প্যানেলে

রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্যানেলের আরও ১১০ জনকে নিয়োগের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সংবাদটি পুরনো না হলেও একেবারে নতুনও নয়। প্রায়শই এ ধরনের সংবাদ ছাপা হয়। গত ১৭ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে এসংক্রান্ত রিপোর্ট দেখে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল- এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছে কথার ছলে বলেছিল, “পড়ালেখা করে বড় হয়েছে কে?” জবাবে অন্য বন্ধু বলেছিল, “যারা বড় হয়েছে তারা পড়ালেখা করেই বড় হয়েছে।” এ নিয়ে যুক্তি-তর্ক ছিল, আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এ উদাহরণটা এ জন্য যে, শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর যেভাবে বালা-মুসিবত নেমে আসছে তাতে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হবে কিনা তা কে জানে। আর শিক্ষার্থীদেরই বা শেখাবে কে? নিশ্চয় শিক্ষকরা। কিন্তু সেই শিক্ষকদের একটি বৃহৎ অংশ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে যদি বঞ্চিত থাকে তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়ায় সেটি বেভে দেখার মতোই ঘটনা।

২০১০ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ২০১১ সালে রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে প্রায় ৪৪ হাজার শিক্ষক মনোনীত হয়েও এখন পর্যন্ত নিয়োগ পায়নি অর্ধেকের বেশি শিক্ষক। অপেক্ষমান শিক্ষকদের ৫ বছরের মধ্যে নিয়োগের কথা থাকলেও সে বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা নেই। বরং জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৬ হাজার রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে স্থায়ীভাবে প্যানেল শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেমে যায়। অপরদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে জানিয়েছেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সরকারি ঘোষণার কারণে ঘোষিত প্যানেল হতে শিক্ষক নিয়োগের আর কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্ন হলো, একই সময়ে পরীক্ষা নিয়ে উত্তীর্ণদের তালিকা প্রকাশ করে এক চতুর্থাংশকে নিয়োগ দেওয়া হলো আর অন্যদের বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে এখন যদি বলা হয় যে তাদের নিয়োগই দেওয়া হবে নাÑতা হলে সেটি কি বঞ্চিতদের প্রতি ন্যায় বিচারের উদাহরণ হবে? সমযোগ্যতা নিয়ে এক শ্রেণির শিক্ষক সরকারি স্বীকৃতি পাবে আর অন্যরা বঞ্চিত হবে এটা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। প্যানেল শিক্ষকরা বারবার কর্মসূচি ঘোষণা করে তাদের অবস্থান জানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কোনো কথাই যেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মন গলাতে পারছে না। সরকারের ইতিবাচক দিকগুলো এসব নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে আড়ালে চলে যাচ্ছেÑএটাও যেন ভাববার কেউ নেই। সরকার যখন শিক্ষকদের কিছু সুবিধা দিচ্ছে আর অনেক কিছু দিবে বলে ওয়াদা করেছে তেমনিভাবে প্যানেল শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু করুক তাহলেই তো বুঝা যাবে সরকার শিক্ষকদের সাথে ন্যায়বিচার করছেন। কিন্তু সরকারতো সে পথে যাচ্ছেন না।

২৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত ভোগান্তির শিকার। তাদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্বের অংশ। রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী নিজ ইউনিয়নে শূন্যপদ না থাকা বা নারী কোটা পূরণ বাধ্যতামূলক থাকায় মেধাতালিকায় শীর্ষ মেধাবীরা শিক্ষক নিয়োগ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। আর ইউনিয়নভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ফলে মেধা তালিকায় অনেক পরে থেকেও তারা নিয়োগ পান। তাই কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করে উপজেলাভিত্তিক মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হলে প্যানেলভুক্ত শিক্ষকরা উপকৃত হবেন। ইতোমধ্যে হাইকোর্ট নীতিগতভাবেই শিক্ষকেদের নিয়োগ দিতে বলছে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন ভিন্ন কথা। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্যানেল শিক্ষকদের মধ্য থেকে পৃথক তিনটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২৬৮ জনকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে উপজেলাভিত্তিক ফলাফলের ভিত্তিতে নিয়োগ দানেরও আদেশ দেন। একই সঙ্গে ইউনিয়নভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ ও নিয়োগ দানকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এছাড়া ‘হাইকোর্ট থেকে আরও প্রায় দেড় থেকে দু হাজার জনকে নিয়োগ প্রশ্নে রুল জারি করা হয়েছে। আগামী মে মাসে এসব রুলের উপর চূড়ান্ত শুনানি হতে পারে।’ তারপরও সেই আদেশ কেবল ফাইলবন্দিই থেকে যায়। এভাবে বন্দিদশা থেকে শিক্ষকরা কবে মুক্তি পাবেন তার উত্তর কারো জানা নেই।

প্যানেল শিক্ষকরা সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পাশাপাশি বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার যদি পরিবর্তন হতো তাহলে বুঝতাম নতুন সরকার প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে নিয়োগ বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু তা-তো নয়। যদিও পরপর দু’টার্ম একই সরকার ক্ষমতায় আছে তাহলে শিক্ষকদের ঝুলিয়ে রাখার কি মানে আছে, তা বোধগম্য নয়। প্যানেল থেকে যদি কাউকে নিয়োগ দেওয়া না হতো তাহলে কোন কথা হয়তো থাকতো না। কিন্তু একটি অংশ যখন তাদের অধিকার প্রাপ্ত হয়েছেন, তাহলে অপেক্ষমানরা কেন অধিকার বঞ্চিত হবেন। গণশিক্ষা মন্ত্রী বলছেন, ‘প্যানেল থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই’। সুযোগ নেই নাকি সুযোগ রাখা হয়নি। সরকার চাইলে পারে না এমনটি দেশের মানুষ মনে করে না। স্বদিচ্ছাই এখানে মূল কথা। শিক্ষককে তার অধিকার আদায় করতে হাইকোর্টের নির্দেশ আনতে হবেÑএই হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সাথে সরকারের ভালো ব্যবহারের নমুনা! আদালতের রায়ের প্রতি নাকি সরকার খুব আন্তরিক।

তাই যদি হয় তাহলে প্যানেল শিক্ষকরা কেন দীর্ঘসময় থেকে ঝুলে আছেন? প্যানেল শিক্ষকদের বিষয়ে সরকারের আরো একটু ভেবে দেখা দরকার। তাদের মনে রাখা উচিত, একজন শিক্ষক শুধু ব্যক্তিই নন বরং একটি পরিবার, একটি সমাজ। যে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়ার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। সেই আদালতই প্যানেল শিক্ষকদের নিয়োগ দানের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশটিকে সরকার উপেক্ষা করেই চলছে। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য আদালতের একটি রায় মানবেন আর অন্যটি উপেক্ষা করবেন-এ রীতি বর্জন করাই শ্রেয়। তখনই কথা আসে ‘প্যানেল শিক্ষকরা হয়তো সরকারের রাজনৈতিক প্যানেলে নেই’ তাই তারা নিয়োগ পাচ্ছেন না।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই