পৃথিবীর যে সকল স্থানগুলো আজও রহস্যময়
সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। তবে সে বদল এতটাই ধীর গতির যে তা শত বছর পরও তাকে বদল বলে মনে হয় না। এই স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে পৃথিবী নামক গ্রহের রহস্যময় আচরণও বিরল নয়। মানুষের এ গ্রহটিতেও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা সকলকে চমকে দেওয়ার মতো।
এই গ্রহে চমক জাগানিয়া এমন অনেক স্থান রয়েছে যা মানুষকে নতুন কিছুর সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। এ ধরণের রহস্যগুলো যখনই মানুষ সমাধান করতে এগিয়ে গেছে তখনই তার সামনে হাজির হয়েছে নতুন কোনো রহস্য। যার পেছনে লুকিয়ে থাকা উত্তর আজো অব্দি রয়ে গেছে সবার অজানায়। নিজের অসাধারণ সৌন্দর্য থেকে শুরু করে মানবসৃষ্টির মাঝখানেও প্রকৃতি খেলেছে এই খেলা। জাল বিছিয়েছে অমীমাংসিত কিছু গল্পের। যেগুলোর অজানা অধ্যায় এখনো সবার কাছে অজানাই হয়ে আছে। প্রতিনিয়ত মানুষ চেষ্টা করে চলছে সত্যিটা জানার। আর এমনই কিছু রহস্যময় স্থানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যেগুলো ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
জলপ্রপাত নয় রক্তপ্রপাত
জলপ্রপাত বলতে আমরা বুঝি পাহাড়ের কোল থেকে পানির প্রচণ্ড ধারাকে নীচে গড়িয়ে পরতে। তাদের উচ্চতা, সৃষ্টি আর সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়েছি আমরা। কিন্তু এর চাইতেও বড় রকমের বিস্ময় প্রকৃতি আমাদের জন্যে তৈরি করে রেখেছে অ্যান্টার্কটিকায়। আর সব প্রপাতের মতন এই প্রপাতটি পাহাড় নয়, বরফের ওপর অবস্থিত। তবে সেটা এর আসল বিশেষত্ব নয়। এই প্রপাতটির বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে আর দশটা প্রপাতের মতন পানি নয় বয়ে পড়ে রক্তের ধারা। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন রক্ত কি করে আসবে এখানে? ঠিক রক্ত নয়। রক্তের মতন লালচে এক ধরনের পদার্থ বয়ে যায় এই প্রপাত থেকে। আর তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে ব্লাড-ফলস বা রক্তপ্রপাত। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে রক্ত না হলেও এই লাল রংয়ের তরলটি কি আর এটি আসেই বা কোথা থেকে? উত্তর জানা যায়নি এখনো। তবে মনে করা হয় এখানকার আশেপাশে লৌহ আর সালফারের ধারা রয়েছে যেগুলোর মিশ্রণেই এই প্রপাতের রং লাল দেখা যায়। প্রমাণ? মেলেনি এখনো।
চুম্বক পাহাড়
কেবল নামেই নয়, কাজেও নিউ ব্রুান্সউইকের মনচটনের এই চুম্বক পাহাড়টি নিজের যথার্থতার প্রমাণ দিয়েছে। ১৯৩০ সালে হঠাত্ করে আবিষ্কার করা হয় যে এই পাহাড়টির আশপাশ দিয়ে কোন গাড়ি গেলে সেটায় কিছু গড়বড় দেখা যায়। বিশেষ করে সেই গাড়িটা যদি এর ওপর দিয়ে পার হতে যায় তাহলে কোনরকম ধাক্কা ছাড়াই পেছনের দিকে কোন এক অদৃশ্য আকর্ষণে গড়িয়ে যেতে থাকে সেটি। প্রথমটায় বেশ অবাক হয়ে যায় সবাই এই অদ্ভূত ব্যাপার দেখে। তবে দ্রুতই গবেষণা শুরু হয়। নানা মানুষ নানারকম মতামত দিতে শুরু করে। এবং একটা সময় গিয়ে সবাই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এই পাহাড়ের আশেপাশে রয়েছে কোন বিশাল আকারের চুম্বক। লৌহ নির্মিত কোন পদার্থ এর পাশে থাকলেই তাই সেটাকে নিজের দিকে টানে সে। তবে এরপর থেকে এখন অব্দি অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলেও খুঁজে বের করা যায়নি সেই চুম্বকটিকে।
হঠাৎ ভেসে ওঠা দ্বীপ
শেষ বরফ যুগ চলে যাওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আর তাই প্রায় অনেকটাই এঁকঘেয়েমিময় হয়ে গিয়েছে এটি অনেকের কাছে। বিশেষ করে যারা পছন্দ করেন পৃথিবী ঘুরতে। এখন আপনার মনে হতেই পারে যে পৃথিবীতে আর কিছু দেখার নেই, নতুন কিছুই নেই এখানে! আর সবার হতাশামূলক এই কথাবার্তার প্রতিবাদেই হয়তো পৃথিবী ১৯৬৩ সালে পানির নীচে একটি অগ্ন্যুত্পাত করে আইসল্যান্ডের দ্বীপগুলোর কাছে। হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকা মানুষগুলোকে আরো একটু চমক দিতেই ১৯৬৭ সালে পরপরই মানুষ খুঁজে পায় সম্পূর্ণ নতুন একটি দ্বীপ যেটা কিনা আগে ছিলই না! পরবর্তীতে মানুষ আইসল্যান্ডের এই নতুন দ্বীপটির নাম দেয় সার্টসে।
রাত হয় না তাই সূর্যও ওঠেনা যেখানে
শুনতে অবাক করা মনে হলেও কথাটি পুরোপুরি সত্যি। আমাদের এখানে প্রতিদিন একবার সূর্য ওঠে। সকাল হয়। দুপুর আসে, বিকেল হয়, সন্ধ্যা নামে। সূর্য ডুবে গিয়ে জন্ম দেয় রাতের। চাঁদ ওঠে আকাশ জুড়ে। রাত শেষে চাঁদ চলে গিয়ে সূর্য উঁকি মারে আবার ঐ আকাশটাতে। কিন্তু নরওয়ের এই স্থানটিতে অদ্ভূতভাবে সূর্য ওঠে না কখনোই। উঠবে কি করে? সূর্য চলে গেলে তবে তো উঠবে! ২০ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সবসময় দিনের আলো থাকে এই স্থানটিতে। রাত নামেই না! ভবুন তো একবার, মাঝরাতেও যদি জানলা খুলে দেখেন যে আখাশে একটা বড়সড় সূর্য ঝুলছে তাহলে কেমনটা লাগবে? আর এমনই সমস্যায় পড়তে হয় লংইয়ারবিয়ানের মানুষদেরকে। দুই-তিনদিন চলার পর শরীর তো শরীর, মানুষ নিজেও ঝামেলায় পড়ে যায় কখন দিন আর কখন রাত সেটার হিসেব রাখতে।
বিদ্যুৎ চমকানির বাড়াবাড়ি
ভেনিজুয়েলার লেক মারাকাইবোর দক্ষিনপশ্চিমে অবস্থিত কাটাকাম্বো ও এর পাশের কাটাটাম্বো নদীতে প্রায়ই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। সারারাত তারা নদীর ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে বেড়ান। কি সেটা? শুনলে অবাক হবেন যে সেটা আর কিছু নয়, বরং বিদ্যুতের চমকানি! ভাবছেন বিদ্যুত্ তো পৃথিবীর প্রায় সবখানেই চমকায়। সেটা দেখবার জন্যে ভেনিজুয়েলায় ছুটে আসবার কি আছে? আছে! আর আছে যে সেটাকে প্রমাণ করতেই কাটাটম্বের এই স্থানটিতে মিনিটে ২৫ কিংবা তার বেশি পরিমাণ বিদ্যুত্ চমকায়। যেখানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে মিনিটে ১২ বার বিদ্যুত্ চমকানোটা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু একটা। এখানকার অসাধারণ পরিবেশ, অবস্থান, বাতাস, পাহাড় আর সাগরের সঙ্গে বাতাসের ঘর্ষণ- এ সবকিছু মিলেমিশেই তৈরি করে অসাধারন এই ব্যাপারটির। এখানকার বৈদ্যুতিক আলোর পৃথিবীর সবচাইতে বেশি আলোর মাত্রা রয়েছে বলেও মনে করেন সবাই।
মাটি ফুড়ে বেরিয়েছে যে ঝর্ণা
মাটি থেকে তৈরি হওয়া ঝর্ণা পৃথিবীতে অনেক আছে। আছে ইয়োলোস্টোন জাতীয় পার্কের মাঝেও বেশ কয়েকটি। তবে এই পার্কটি যদি কোন একটি জিনিসের জন্যে তৈরি হয়ে থাকে সেটি হচ্ছে একটি ঝর্ণাই। আর সেই ঝর্ণাটির নাম ওল্ড ফেইথফুল। ওল্ড ফেইথফুলের জন্যেই আমেরিকায় প্রথমবারের মতন ১৮৭২ সালে ইয়োলোস্টোন উদ্যানকে জাতীয় উদ্যানের সম্মানে ভূষিত করা হয়। ঝর্ণাটিতে প্রতি ৫৫ থেকে ১২০ মিনিট পরপর উদগীরন হয় এবং সেটা টিকে থাকে টানা দুই থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত। পার্কে প্রতি বছর বেড়াতে আসা ৩.৫ মিলিয়ন পর্যটকের জন্যে সবসময়কার প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে এই অসাধারণ আর অনন্য ঝর্ণাটি।
যে জলে আগুন জ্বলে
নিউ ইয়র্কের অচার্ড পার্কে প্রবেশ করলে একটা ব্যাপার চোখে পড়বে আপনার আর খটকাও লাগবে। আর সেটি হল এর একটি ঝর্ণা। আর সব ঝর্ণার মতনই স্বাভাবিক এই ঝর্ণার একটিই অস্বাভাবিকতা হচ্ছে এর পানির ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা। কি করে পানির ভেতরে আগুন জ্বলছে ওখানে? নিশ্চয় ভাবছেন আপনি। উত্তরটা খুব সহজ এবং সেটা আছে পানির ওপাশেই। প্রথমটায় অদ্ভূত লাগলেও তখন আর খুব একটা অদ্ভূত মনে হবেনা একে যখন আপনি জানবেন যে ওখানে কেবল পানি নয়, আছে ভূগর্ভস্থ গ্যাসও। ভূপ্রাকৃতিক কারণে এখানে প্রতিদিন প্রায় ১ কিলোগ্রাম মিথেন গ্যাস নির্মন হয়। আর সেই হ্যাসকে লক্ষ্য করেই আনুমানিক ২০ শতকের দিকে কোন একজনের মাথায় আসে এখানে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার। যেই ভাবা সেই কাজ! জ্বালানো হল আগুন। ভাবছেন পানিতে কি কখনো নিভে যায়না এই আগুন? যায়! তবে কেউ একজন এসে আবার সেটাকে জ্বালিয়েও দিয়ে যায় আর জ্বালিয়ে রাখে পানির ভেতরের আগুনকে।
গড়িয়ে চলা পাথর
১৯১৫ সালের কথা সেটা। এক প্রোসপেক্টর আর তার স্ত্রী এসেছিলেন ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে। সেসময়ই একটি পাথর চোখে পড়ে তাদের। সেই সঙ্গে চোখে পড়ে পাথরের একটা গতিপথকেও। পুরো ব্যাপারটা এমন যেন মনে হয় পাথরটি গড়িয়ে গড়িয়ে অনেকটা পথ এসেছে। কিন্তু কি করে? একটা পাথর কি করে একা একা গড়িয়ে গড়িয়ে চলাফেলা করতে পারে এতটা পথ? ১৯১৫ সালে প্রশ্নটি উঠেছিল। ২০১১ সালে বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিজেদের ধারণার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- পাথরের চারপাশে বরফ জড়িয়েছিল যেটা কিনা গলতে গলতে পাথরটিকে এতটাদূর এনেছে। আর এভাবেই চলতে পেরেছে পাথর। কিন্তু সেটা আদতেই এর সত্যিকার কারণ কিনা তা এখনো রয়ে গিয়েছে অজানাই!
মন্তব্য চালু নেই