পাহলোয়ান উৎপাদনের গ্রাম
তথাকথিত উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত। টাটা-বিরলার মতো বিশাল সব করপোরেট জায়ান্ট কোম্পানিগুলো এখন ভারতের স্টেকহোল্ডার। আর এই উন্নয়নের জোয়ারে দেশটি নানামুখী পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যে পড়তে হচ্ছে অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের পেশা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। দেশ হারাচ্ছে তার কৃষ্টি, কৃষক, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
ভারতের বৃহৎ শহরগুলোতে এখন বার, নাইটক্লাব, জুয়ার হাউস বেশ আখড়া গেড়ে বসেছে। এক শ্রেণীর মানুষের চাহিদার জোগান দিতে বাধ্য হয়ে নানান পেশার মানুষকে যুক্ত হতে হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তেমনি একটা পেশা ‘বাউন্সার’। বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে উত্ত্যক্তকারী ব্যক্তিকে শায়েস্তা করার জন্য নিয়োগ দেয়া পেশিবহুল মানুষদের বলা হয় বাউন্সার। তবে বাউন্সাররা যে শুধু নাইটক্লাব কিংবা বারে চাকরি করেন তা নয়। বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাউন্সারদের ব্যাপক চাহিদা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাউন্সারদের দিয়ে জোরজবরদস্তির কাজ করা হয় এই খবরও ভারতীয় গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি।
দেশটির একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নাম গুরগাঁও। এই গ্রামের তরুণদের কাছে দিল্লি হলো এক অদ্ভুত ‘মিলেনিয়াম সিটি’। কারণ এই মিলেনিয়াম সিটিতে গেলেই মেলে চাকরির খোঁজ এবং একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার অনুসঙ্গ। শহরের বিভিন্ন নাইটক্লাব আর মদের দোকানগুলো গুরগাঁওয়ের তরুনদের কর্মসংস্থানের নতুন ঠিকানা। অধুনা মধ্যবিত্তদের তুলতুলে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক সন্তানদের কাছে বিগত কয়েক বছর ধরেই নাইটক্লাব সংস্কৃতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাঞ্জাবি পপ গান আর ভিনদেশি হেভি মেটাল গানের কল্যাণে দিল্লির আনাচে কানাচে এখন অনেক ক্লাব গজিয়ে উঠেছে যেখানে উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের সন্তানেরা তাদের অবসর বিনোদন করে।
ভিনদেশি সংস্কৃতি গ্রহণের মাধ্যমে একদিকে যেমন ভারতের শহরগুলোতে বাড়ছে নাইটক্লাবের সংখ্যা তেমনি এই ক্লাবগুলোতে মারামারির পরিমানও বাড়ছে। আর এই মারামারি এবং অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সমাধানে নাইটক্লাবগুলো ব্যবহার করছে বাউন্সারদের। দিল্লির বেশিরভাগ নাইটক্লাবেই এ ধরনের মারকুটে চেহারার অনেককে দেখতে পাওয়া যায়।
দক্ষিণ দিল্লি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী আসোলা ফতেপুর বেরি গ্রামের একটি ভিআইপি ফার্ম হাউসে নাইটক্লাবে বাউন্সার সাপ্লাইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই ফার্ম হাউসের প্রধান প্রশিক্ষক হলেন বিজয় তানোয়ার। তার তত্ত্বাবধানে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ছেলেকে শারীরিক কসরতে পারদর্শী করা হয়। প্রধান প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট মিললেই তবে তারা শহরে গিয়ে চাকরির সন্ধান করতে পারেন।
বিজয় তানোয়ারের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘এই গ্রামের প্রতিটি ছেলেই আমার কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। এখানকার সব ছেলেই প্রতিদিন শারীরিক কসরত করে। শরীর সম্পর্কে তারা বেশ সচেতন। তাদের মধ্যে কেউই মদ খায় না, এমনকি সিগারেটও সেবন করে না।’
স্থানীয় অনেকের ধারণা, শারীরিক কসরতের কারণে তারা একদিন অলিম্পিকে যেতে পারবে। কিন্তু বেশিরভাগ চাষী পরিবার থেকে আসা এই যুবকরা কেউই অলিম্পিক বা অন্যান্য খেলায় যায় না। কারণ অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের বাধ্য করে নাইটক্লাবের বাউন্সার হতে। গুরগাঁওয়ের প্রায় ২০০ জন তরুণ বিভিন্ন নাইটক্লাব ও পাবে চাকরি করেন। এছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তির দেহরক্ষী হিসেবেও তারা কাজ করে। তবে এই বাউন্সারদের নির্দিষ্ট কোনো পারিশ্রমিক নেই। বড় বড় নাইটক্লাবগুলোতে অনেক সময় একেক জন বাউন্সারকে মাসিক ৫০ হাজার রুপি চুক্তিতেও নেয়া হয়। আবার কখনও মাত্র ১০০ রুপির বিনিময়েও অনেক বাউন্সারকে কাজ করতে হয়। পারিশ্রমিকের বিষয়টি মূলত নির্ভর করে কাকে কতটা বীভৎস দেখতে তার উপর।
সম্প্রতি কলকাতা টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুসতাক খান নামের একজন বাউন্সার বলেন, ‘আমাদের পেশি এবং চাহনিই অনেক সমস্যা সমাধান করার জন্য যথেষ্ট। আপনার চেয়ে দ্বিগুন সাইজের কেউ যখন আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি ভড়কে যাবেন।’
মন্তব্য চালু নেই