নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলাকারীরা আসলে কারা?
মশিউল আলম : ‘ওরা দল বেঁধে আইছে। তছনছ কইরা দিছে। বাড়িতে রাখা আমার পুলার বউয়ের দুই ভরি স্বর্ণসহ বাড়ির সব দামি জিনিসপত্র লুট কইরা নিছে। আমার দুই বছরের নাতিটা তখন ভয়ে কাঁপতাছে। একজন তখন কইল, এইটারে জবাই কর। আমি হেরার কাছে কাকুতি-মিনতি করলাম। কেউ একজন তখন কইল, কানের দুলটা খুইল্যা দে। আমি ভয়ে ভয়ে খুইলা দিছি।’
এই কথাগুলো পূর্ণিমা দাস নামের এক নারীর, যিনি তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে এমন ‘তাণ্ডব’ কখনো দেখেননি বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদকদের বলেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে মানুষেরা গত রোববার প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক শ লোকের সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছেন, পূর্ণিমা দাস তাঁদের একজন।
হিন্দুদের ১৫টা মন্দির ও শতাধিক বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে নয়, বেলা ১১টার ঝলমলে আলোয় কয়েক শ মানুষ অংশ নিয়েছে ওই হামলায়। কারণ? ফেসবুকে প্রচারিত একটা ছবিতে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। ছবিটা প্রচারিত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক তরুণের আইডি থেকে, যিনি বলেছেন, অন্য কেউ তাঁর আইডি থেকে সেটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন, তিনি ছবিটা দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা ওই তরুণকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে, ফলে আইনের পথেই বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ ছিল।
কিন্তু তারপরও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ লাগার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় কিছু লোক গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালিয়েছ। কিন্তু শুধু ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ নয়, এই দুর্বৃত্তপনার পেছনে বৈষয়িক লোভ-লালসাও যে কাজ করেছে, পূর্ণিমা দাসের কথা থেকে তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। কিংবা এমনও হতে পারে যে ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত অজুহাত মাত্র; এই সুযোগে ওই লোকগুলো আসলে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছিল। স্বর্ণালংকার ও দামি জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত কোনো মানুষের কাজ নয়, স্রেফ ডাকাতের কাজ। আর যখন একজন বৃদ্ধ নারী তাঁর দুই বছর বয়সী নাতির প্রাণভিক্ষা চেয়ে কাকুতি-মিনতি করেন, তখন যারা তাঁকে কানের দুল খুলে দিতে বলে, তারা যে কত ইতর প্রকৃতির ডাকাত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আক্রমণের শিকার প্রতিটি বাড়িতেই লুটপাট হয়েছে। মন্দিরগুলোতে শুধু যে মূর্তি ভাঙা হয়েছে তা নয়, রুপা, কাঁসা, পিতল ও তামার তৈরি মূর্তি লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নাসিরনগরের এই ঘটনার সঙ্গে ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলার ঘটনার একটা মিল হলো, দুটি ঘটনারই সূত্রপাত ফেসবুকের মাধ্যমে। কিন্তু রামুর সঙ্গে নাসিরনগরের পার্থক্য হলো, রামুতে হামলা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে আর নাসিরনগরে হামলাকারীরা হামলা চালিয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। অভিযোগ আছে, দুটি সংগঠনের ধর্মীয় সমাবেশ থেকে কিছু লোক ছুটে গিয়ে হিন্দুদের বিভিন্ন মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা চালাতে শুরু করে।
নাসিরনগরের আক্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। তাঁদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক রয়ে গেছে। তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, ‘বাড়াবাড়ি’ করলে আবার হামলা চালানো হবে। ‘বাড়াবাড়ি’ মানে প্রতিবাদ করা, অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করা, বিচার চাওয়া। আক্রান্ত হিন্দুদের বিচার চাওয়া চলবে না, নীরবে সব অন্যায় সহ্য করে যেতে হবে।
নাসিরনগরের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আক্রান্ত পরিবারগুলোকে যৎসামান্য আর্থিক সহযোগিতা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনায় সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মনে যে তীব্র আঘাত লেগেছে, ওই ক্ষতিপূরণে তার উপশম ঘটবে না। তাদের মনে যে ভয় ঢুকেছে, যে তীব্র নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে।
প্রথমত, হামলাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে, এই হামলার সুষ্ঠু বিচার করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আক্রান্ত হিন্দুদের মনে এই আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে যে বাংলাদেশে ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর ও সচেষ্ট রয়েছে। ধর্ম-সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হবে, কিন্তু সরকার তার কোনো আইনি প্রতিকার করতে পারবে না—এমন অবস্থা যদি সাধারণ বাস্তবতা হয়ে ওঠে, তাহলে এই রাষ্ট্র ও সমাজের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে।
দ্বিতীয়ত, হামলাকারীদের বিচার করা অত্যন্ত প্রয়োজন এই কারণেও যে তারা হিন্দুদের মন্দির ও ঘরবাড়ি লুট করেছে; সোজা কথায় ডাকাতি করেছে। উপরন্তু, তারা এই ডাকাতি করেছে দিনেদুপুরে, সংঘবদ্ধভাবে। এর বিচার না হলে এই ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধের প্রবণতা ভীষণভাবে বেড়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত এবং প্রধানত, নাসিরনগরের আক্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর প্রতি সৌহার্দ্য, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে মুসলমান সম্প্রদায়কে। আশপাশের গ্রাম-জনপদগুলোর মুসলমান ভাইবোনদের এগিয়ে যেতে হবে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আক্রান্ত হিন্দুদের মনে এমন আস্থা সৃষ্টি করতে হবে, তাঁদের ওপর যারা আক্রমণ চালিয়েছে, মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে, তারা যতই ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলুক, তারা বিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক ও স্বার্থবাদী চক্রগুলোর প্রতিনিধি। এ দেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমান সম্প্রদায়ের তারা কেউ নয়। ধর্ম-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সবাই মিলে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের যে অঙ্গীকার স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনার অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চক্রান্তে ও দুর্বৃত্তপনার কাছে তা হার মানতে পারে না।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মন্তব্য চালু নেই