নাজিমউদ্দীন রোড থেকে স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় কারাগার
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডে ব্রিটিশ সরকারের আমলে ১৭৬৫ সালে নির্মিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি অবশেষে স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায়। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সরিয়ে নেয়া হবে বলে কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, এ কারাগারটি হবে এশিয়ার সর্ববৃহত কারাগার। শুধু বিচারাধীন বন্দীদের রাখার জন্যই এ কারাগারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বিচারাধীন বন্দীদের কারাবাসে সহায়তার জন্য কিছুসংখ্যক কয়েদিকে এ কারাগারে রাখা হবে। তাছাড়া ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী, জঙ্গী, কিশোর অপরাধী, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা স্থানে রাখার জন্য পৃথক পৃথক বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্থানান্তরের পর এ কারাগারটির নাম বর্তমানের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পাল্টে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার রাখা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ও এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মতোই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে মোট ৪ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরুষের জন্য ২টি পার্ট ও মহিলা বন্দীদের জন্য ১টি পার্ট এবং কারাগারের বাইরের অংশে ২০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। ১শ’ ৯৪ দশমিক ৪১ একর জমি নিয়ে নির্মাণাধীন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধাসমৃদ্ধ কারাগারটির ৩টি ডিভিশনের পুরুষের পার্ট-১ এ ৪ হাজার বন্দী, পুরুষ ২-এ ৪ হাজার বন্দী ও মহিলা কারাগারে ৩০০ মহিলা বন্দী রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সকল রোগী কারাবন্দীকে ২শ’ শয্যার হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা প্রদান করা হবে। ৩শ’ ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হওয়া এ কারাগারটির নির্মাণ ব্যয় ৭৭ কোটি টাকা বেড়ে ৪শ’ ১৪ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে বলে কারাসূত্র নিশ্চিত করেছে। গণপূর্ত অধিদফতরের নির্দেশক্রমে ও হিসাব মতে এ নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে বলে জানা গেছে। তবে এ ব্যয় পুরুষ পার্ট-১ এবং মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণ ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছে। সম্পূর্ণ কারাগারটি নির্মাণে ব্যয় বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রচুর পরিমাণ ফাঁকা জায়গা রেখেই আধুনিক ব্যবস্থা সমৃদ্ধ নতুন কারগারটি তৈরি করা হচ্ছে।
কারাভ্যন্তরে বিশ্বের উন্নত দেশের কারাগারের ন্যায় ৬ তলাবিশিষ্ট ৮টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ভবনে ৫শ’ বন্দীকে রাখা হবে। তাছাড়া স্বাভাবিক বন্দীদের থেকে আলাদা রাখতে বিশেষ নিরাপত্তা সেল তৈরি করা হচ্ছে। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী, দুর্ধর্ষ ৪শ’ আসামিকে রাখার জন্য ৪ তলাবিশিষ্ট ৪টি ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতিটি ফ্লোরে ১শ’ বন্দীকে রাখা হবে। ৬০ জন ভিআইপি অর্থাৎ ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের রাখার জন্য ৬০টি বিশেষ কক্ষ তৈরি করা হবে। কিশোর অপরাধে অভিযুক্ত ১০০ কিশোর বন্দীকে রাখার জন্য বিশেষ সেল তৈরি করা হবে। তাছাড়া ৩০ মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দীর জন্য আলাদা ভবন তৈরি করা হবে। যাতে শুধু মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীরা থাকবে।
কারাগারের বাইরে কর্মরত কর্মকর্তাদের ৫০টি পরিবারের আলাদা ইউনিট ও কর্মচারীদের ৩৫০টি পরিবারের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনোদনে অফিসারদের জন্য অফিসার্স ক্লাব, কর্মচারীদের জন্য স্টাফ ক্লাব, স্কুল, মসজিদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সভার জন্য অডিটরিয়াম নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া কারাগার কম্পাউন্ডে ১ হাজার কারারক্ষীর থাকার জন্য ব্যারাক নির্মাণ করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৩শ’ কারারক্ষী থাকার ব্যারাক নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২শ’ শয্যার হাসপাতালটিতে ৩ ভাগে বিভক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করা হবে। একটি ভাগে সারাদেশের অসুস্থ কারাবন্দীদের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ আলাদা ভাগে চিকিৎসা প্রদান করা হবে। অপর অংশে কারাগারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। যেখানে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হবে। শেষ অংশে কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসরত গ্রামবাসী ও সাধারণ জনগণের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা থাকবে।
২টি পর্বে এ কারাগার ৩টি ও ২শ’ শয্যার হাসপাতালটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম পর্বে পুরুষ কারাগার পার্ট-১ এবং মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে পুরুষ পার্ট-২ এবং হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি কারাগারে থাকার স্থান সমস্যা দূর করতে প্রত্যেক বন্দী থাকার জন্য গড়ে ৩৬ বর্গফুট স্থান রাখা হবে। যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ও জেলকোড অনুযায়ী স্বীকৃত। ফলে থাকার জায়গা নিয়ে বর্তমানের মতো আর কোন বন্দীর সমস্যা থাকবে না। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬শ’ ৬০ জন বন্দীর জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে সাড়ে ৭ হাজার বা সময় বিশেষে আরও বেশি বন্দী রাখা হয়।
সূত্রমতে, গড় হিসেবে প্রতিটিতে ৪ হাজার বন্দীর ধারণ ক্ষমতা থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে আরও বেশি বন্দীর ঠিকানা হবে এ ইউনিটে। তাছাড়া প্রতিটি ইউনিটে ভবিষ্যতে যাতে আরও ৪ হাজার বন্দী রাখার মতো ভবন নির্মাণ করা যায় তার সমপরিমাণ জায়গা রেখেই বর্তমান ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও প্রায় ৩৪ বছর পর বর্তমান সরকার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়ার পর থেকেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। ২০০৭ সালে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে মূল কারাগার ভবন নির্মাণের কাজ জোরেশোরে শুরু করে। ২০১৩ সালের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ না হওয়ায় ও অর্থ সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
মন্তব্য চালু নেই