নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে বিএনপি

ঢাকা সিটি করপোরেশন দু’ভাগে বিভক্তির প্রতিবাদে হরতাল দিয়েছিল বিএনপি। এমনকি ক্ষমতায় গেলে দুই সিটি করপোরেশনকে এক করার ঘোষণাও দিয়েছিল দলটি। কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে সেসব ভুলে গেছেন দলটির নেতারা। এখন নাকে খত দিয়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

বিএনপি যদি এ নির্বাচন মেনেই নেবে, হরতাল দিয়ে গাড়ি পোড়ানো এবং দুই ডিসিসি এক করার ঘোষণা কেন দিয়েছিল। তারা কি আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে? তাহলে ক্ষমতায় গেলে দ্বি-খণ্ডিত ডিসিসিকে আর এক করবে না? এমন প্রশ্ন এখন নগরবাসীর মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে।

এসব প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান  বলেন, তখনকার প্রেক্ষাপটে কী বলেছিল- সে বিষয়ে এখন ভাবছে না বিএনপি। এখনকার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।

বিএনপি তাদের আগের ঘোষণা থেকে সরে এসেছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ক্ষমতায় গেলে যদি একীভূত করার প্রশ্ন আসে তখন ‍একীভূত করা হবে। এখন এ বিষয়ে ভাবছে না বিএনপি।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন  বলেন, এই দলটির নীতিই হচ্ছে স্ট্যান্টবাজি। স্বভাবতই তারা পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এতে অবাক হইনি আমি। তারা অনেক কিছুই দেরিতে বোঝে।

তারা বিগত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছে তা এখন উপলব্ধি করছে। লন্ডনে বসে দেওয়া নির্দেশনা দিয়ে যে কাজ হবে না- এ বিষয়টি দলটির নেতারা বুঝে গেছেন বলেও মন্তব্য করেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপির প্রত্যেকটি কথা ও কাজে বৈপরীত্য থাকে। আবারও তারা সেটাই প্রমাণ করলেন। কখনই তাদের কথা কাজে মিল পাওয়া যায় না। তারা মুখে বলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী।

তবে বিএনপির এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান ড. হাছান মাহমুদ।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ ‍স্বপন বলেন, অযথা হরতাল দেওয়া বিএনপির সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তারা ডিসিসি ভাগের সময় হরতাল দিয়ে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে নির্বাচনে এসেছে। এখন তাদের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ফিরে দেখা ডিসিসি বিভক্তি
২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ডিসিসিকে উত্তর- দক্ষিণে ভাগ করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। তখন থেকেই প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ডিসিসি মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সেই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

খোকার ইন্ধনেই সে বছরের ২৩ নভেম্বর থেকে ধর্মঘটের ডাক দেয় ডিসিসির কর্মচারীরা। ২৭ নভেম্বর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যেই ২৯ নভেম্বর সংসদে ডিসিসি বিভক্তি বিল পাশ হয়। এরপর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। ওইদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করে দলটি। সেখানে খোকা ছাড়াও দলের সিনিয়র নেতারা অংশ নেন।

সংসদে বিল পাশের পরদিন ৩০ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন খোকা। এখানেই শেষ নয়, প্রতিবাদে ৪ ডিসেম্বর রোবাবর সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় তার দল। সেদিন ঢাকা শহরের বেশ কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। কোর্ট চত্বরে পুলিশের গাড়িতেও আগুন দেয় বিএনপি ক্যাডাররা।

সাদেক হোসেন খোকা স্পষ্ট করে সেদিন ঘোষণা দেন, এই বিভক্তি তারা মেনে নেবেন না। একটি পত্রিকাকে দেওয়া এক স‍াক্ষাৎকারে খোকা তখন দাবি করেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা ক্ষমতায় গেলে আবার ডিসিসিকে একীভূত করবেন।

কিন্তু বিএনপি নেতারা তাদের সেই বক্তব্য এখন পুরোপুরি ভুলে গেছেন বলে বিস্মিত হচ্ছেন সবাই।

১৬১০ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮২৩ সালে ‘কমিটি অব ইমপ্রুভমেন্ট’ নামে একটি কমিটি গঠন করে ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য। ১৮৪০ সালে ‘কমিটি অব ইমপ্রুভমেন্ট’ পরিবর্তন করে ‘ঢাকা কমিটি’ গঠন করা হয়।

১৮৬৪ সালে ঢাকা ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৮৮৪ সালে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। এই কর্তৃপক্ষের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন আনন্দ চন্দ্র রায় এবং ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খাজা আমিরউল্লাহ। ১৯২২ সালে প্রণয়ন করা হয় বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট। এই আইনের মাধ্যমে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষে মহিলা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে ওয়ার্ড কমিশনারের পদ সংরক্ষণের বিধান চালু হয়।

১৯৫৩ সালে আবার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি কমিটির নির্বাচন হয়। ১৯৫৯ সালে এই মিউনিসিপ্যালিটি বাতিল করা হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল এলাকায় ৩০টি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো পৌরসভা অধ্যাদেশ জারি করে ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি’ গঠন করা হয়। এতে মোট ওয়ার্ড ছিল ৫০টি। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিকে করপোরেশনে উন্নীত করে এর নামকরণ করা হয় ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি করপোরেশন।

১৯৮২ সালে সেনাশাসক এরশাদ সরকার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে মিরপুর ও গুলশান নামে আরও দুটি মিউনিসিপ্যালিটি সৃষ্টি করে এবং পৃথক প্রশাসক নিয়োগ করেন। এ সময় তিনটি মিউনিসিপ্যালিটিতে ওয়ার্ডসংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬। ১৯৯০ সালে গুলশান ও মিরপুর মিউনিসিপ্যালিটি বাতিল করে ঢাকা সিটি করপোরেশন গঠন করা হয় এবং দশটি আঞ্চলিক অফিস সৃষ্টি করা হয়। ১৯৯৩ সালে নতুন অধ্যাদেশ জারি করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের বিধান করা হয়।

১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেয়র নির্বাচিত হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ (প্রয়াত)। এরপর ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে হয় ডিসিসি পরবর্তী নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা মেয়র নির্বাচিত হন। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও পরবর্তী নির্বাচন না হওয়ায় সাড়ে নয় বছর দায়িত্ব পালন করেন।



মন্তব্য চালু নেই