নভেম্বরেই পানিশূন্য তিস্তা ব্যারেজ!

তিস্তা যেন এখন আর কোনো নদী নয়, একটি মরা খাল। ভারতের গজলডোবা এলাকার প্রবেশ মুখেও লালমনিরহাটের দোয়ানিতে ব্যারেজ নির্মাণ করে এ নদীর উচ্ছ্বল দুর্বার গতিকে সভ্য সমাজের মানুষরা রোধ করে দিয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে তিস্তার স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে তার বুক থেকে তুলে নেয়া হয়েছে পানি নামের জীবন। মরে গেছে তিস্তা। এই নদীর পারে দাঁড়ালে এখন বাতাসে শুনতে পাওয়া যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস আর গুমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ। দীর্ঘ এ তিস্তার বুকজুড়ে শুধুই ধু-ধু বালুচর। প্রতিদিনই পানির কমতে থাকায় আশা-নিরাশা ও লুকোচুরির কবলে পড়েছে এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা। তিস্তা ব্যারেজ নভেম্বরেই পানিশূন্য তিস্তা ব্যারেজ!

খরস্রোতা তিস্তা নদীর নাব্যতা এতোটাই হ্রাস পেয়েছে যে আসন্ন রবি মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই পানি কমছে। নদীর বুকভরা বালুচর। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর। ব্যারেজ থেকে শুরু করে তিস্তার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পানি না থাকায় ভেঙে পড়েছেন ব্যারেজের সুবিধাভোগী কৃষকরা।
তারা বলছেন, বারবার দু’দেশের র্শীষ পর্যায়ের বৈঠকে ব্যারেজে পানি প্রবাহের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও আজঅবধি কোনো সুরাহা না হওয়ায় ব্যারেজের ভবিষৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তিস্তার পানি প্রবাহ এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে যেখানে প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি, সেখানে বর্ষা শেষ না হতেই ব্যারেজ এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র আড়াই হাজার কিউসেক।

পাউবো কর্তারা জানায়, পর্যাপ্ত পানির অভাবে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম ভেঙে পড়বে। তাই আসন্ন সেচ মৌসুমে তিস্তার পানির হিস্যা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এক মাস পরেই সেচনির্ভর ইরি-বোরো ও রবি আবাদের কার্যক্রম শুরু হবে।

কৃষকদের মতে, বোরো রোপন থেকে গাছের শীষ হেলে না পড়া পর্যন্ত সেচ প্রদানের মুখ্য সময়। সে পর্যন্ত বোরো আবাদের জন্য সেচ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের সেচের আওতাভুক্ত এলাকার কৃষকরা তিস্তার সেচকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ বলে মনে করেন।

৩১ অক্টোবর তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় পানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১২শ কিউসেক। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যারেজে প্রকৃতপক্ষে পানির প্রয়োজন প্রায় ২০ হাজার কিউসেক।

তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কর্তব্যরত ডালিয়া পওর বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান জানায়, তিস্তা ব্যারেজের সেচের পানি দিয়ে আসন্ন সেচনির্ভর বোরো আবাদে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারী জেলায় ২৬ হাজার ৫শ হেক্টরে, দিনাজপুর জেলায় ২ হাজার হেক্টরে ও রংপুর জেলায় ২৫ হাজার ৫শ হেক্টরে। অভিন্ন তিস্তার উজানে বিজনবিভূই এলাকায় ভারত গজলডোবা নামক ব্যারেজ নির্মাণ করে ১৯৮৭ সাল থেকে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে আসছে।

গত বছরের এক জরিপে জানা যায়, সর্ব সাকুল্যে তিস্তাতে পানি পাওয়া যায় ১ অক্টোবর ৪ হাজার ৮৮৪, ২০ অক্টোবর ৪ হাজার ৩০৫ এবং ২ নভেম্বর ব্যারেজের মূল গেটের পানি প্রবাহ ছিল মাত্র ১ হাজার কিউসেক। যা দিয়ে তিস্তা ব্যারেজের সেচ প্রকল্পের সেচ কার্যক্রম চালানো কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া পওর বিভাগের ওই প্রকৌশলী আরো জানান, পর্যাপ্ত পানির অভাবে তিস্তা ব্যারেজের সেচ কার্যক্রম কোনোভাবেই চালু করা সম্ভব হবে না। ভরা বর্ষায় ব্যারেজ এলাকায় যেখানে পানি থাকার কথা ৩০ হাজার কিউসেক। সেখানে বর্ষা শেষ না হতেই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে ব্যারেজ এলাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের সেচ কার্যক্রম চালাতে তিস্তায় পানির প্রয়োজন হবে শুল্ক মৌসুমে প্রায় ২০ হাজার কিউসেক। কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের সেচ ক্যানেল বগুড়া পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। এ জন্য তিনটি ইউনিটে ভাগ করে এর কাজ চলছে। প্রথম ইউনিটের কাজ চলছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হবে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি ও বিরামপুর উপজেলা পর্যন্ত। এরপর তৃতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হবে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার ধুনট পর্যন্ত।

কৃষি বিভাগ জানায়, আসন্ন মৌসুমে রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে। এই পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদে বিদ্যুৎ, ডিজেল ও পা চালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হবে মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৬১টি। এরমধ্যে ডিজেল চালিত গভীর নলকূপ রয়েছে ১৪৯টি, অগভীর নলকূপ ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৪টি, পাওয়ার পাম্প ৮৪৩টি ও বিদ্যুৎ চালিত ৫৬ হাজার ৩৮২টি সেচযন্ত্র এবং ২৭ হাজার ৬৮৩টি পা চালিত সেচযন্ত্র।



মন্তব্য চালু নেই