দিশেহারা মদন

ভিতরে দলের নাম, বাইরে বাম, নতুন খেল্ ক্রীড়ামন্ত্রীর

এ যেন দুই মদনের গপ্পো। এক মদন কোর্টে গিয়ে বিচারকের সামনে দাবি করেন, জোর করে তাঁকে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলিয়ে নিতে চাইছে সিবিআই। শুক্রবার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্স থেকে আলিপুর আদালতে যাওয়ার পথে যিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, সিবিআইকে তিনি সিপিএমের তিন রাজ্য নেতা মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী ও রবীন দেবের নাম জানিয়েছেন।

কিন্তু সিবিআই অফিসারেরাই জানাচ্ছেন আর এক মদনের কথা। যে মদন জেরার মুখে তৃণমূলেরই ১০ জন নেতার নাম করেছেন বলে তাঁদের দাবি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ক্রীড়ামন্ত্রীর দেওয়া তথ্যে সারদার সঙ্গে শাসক দলের যোগাযোগ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। ওই বয়ানের জোরে কয়েক জন তৃণমূল নেতাকে চিহ্নিত করে তাঁদের তলবের তোড়জোড় চলছে।

তবে কি জেরার টেবিলে ও প্রকাশ্যে দেখা দিচ্ছেন দুই আলাদা মদন? নাকি এই সবই ক্রীড়ামন্ত্রীর নতুন খেল্? যা দেখে এক তদন্তকারী পর্যন্ত বলে ফেললেন, “একই অঙ্গে দুই রূপ!” কিন্তু ভিতরে-বাইরে দু’রকম কথা কেনই বা বলবেন তিনি?

বাম নেতারা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, গোটাটাই মদনের রাজনৈতিক চাল। সেলিমের কথায়, “উনি ওঁর দিদিকে দেখাতে চাইছেন, উনি লাইনেই আছেন! ভিতরে তৃণমূলের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি বলে দিচ্ছেন। বাইরে আমাদের নাম বলে বার্তা দিচ্ছেন, যাতে প্রতিবাদ ভেস্তে না যায়!”

এ দিন মদনকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেন, তিনি জেরায় কাদের নাম বলেছেন? তখনই মদন ওই তিন বাম নেতার নাম করেন। তা হলে সিবিআই তাঁদের ডাকছে না কেন? এ বার মন্ত্রীর জবাব, “সিপিএম বলে ডাকছে না!” কীসের ভিত্তিতে তিনি এই অভিযোগ করছেন? রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) যখন তদন্ত চালাচ্ছিল, তখন তাদের কেন এই তথ্য দেননি ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী? সিট কেন বাম নেতাদের কাউকে জেরা করল না? এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি মদন।

অভিযোগ ওঠামাত্রই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্য পাল্টা বলেছেন, রাজ্য সরকারের ‘সিট’ সুজনবাবুকে দু’বার নোটিস পাঠিয়েছিল। সুজনবাবু যেতে পারেননি। সিট-ও শেষ পর্যন্ত আর তাঁকে জেরা করে উঠতে পারেনি। আর রবীনবাবু নিজেই এ দিন বলেছেন, “আমাকে সিবিআই ডেকেছিল ১৯ সেপ্টেম্বর। আর মদন ১৯ ডিসেম্বর সিবিআই হেফাজত থেকে জেল হাজতে যাচ্ছেন। আমি বাইরে, উনি ভিতরে!”

এক ধাপ এগিয়ে সিপিএম সাংসদ সেলিম কটাক্ষ করেছেন মদনের মানসিক ভারসাম্য নিয়ে। সেই সঙ্গে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকে বলছেন, সিপিএমের সব দোষ। তা হলে সিট কিছু করল না কেন? এখন মদনের মুখ দিয়ে সিপিএম নেতাদের নাম বলাতে হচ্ছে কেন?” সুজনবাবুর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী যেখানে আমাকে গ্রেফতার করা উচিত বলেছেন, মদনবাবু তো বলবেনই!” তিনি চিট ফান্ডে প্রতারিতদের নিয়ে আন্দোলনে আছেন বলেই তাঁর নাম জড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন সুজনবাবু। আর মদনের অভিযোগ শুনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, “আমাদের কেউ দোষী হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা তো তৃণমূল নই যে, জেলেও থাকবে, মন্ত্রিসভাতেও থাকবে! এ তো নজিরবিহীন ঘটনা!”

সিবিআই সূত্রের খবর, এই ক’দিনে জেরায় একাধিক বার ভেঙে পড়েছেন মদন। তৃণমূলের কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় নেতা-সহ মোট ১০ জনের নাম বলেছেন তিনি। যে প্রসঙ্গে সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “মদনবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। আরও কয়েক জন নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হতে পারে।” মদনের আগের বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিষ্ণুপুরে একটি মন্দির তৈরিতে তাঁকে এক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে এর আগে অভিযোগ করেছিলেন সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন। ওই টাকার সন্ধানে এ দিন অছি পরিষদের দুই প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। কিন্তু তাদের দাবি, ওই প্রতিনিধিরা বলেছেন, ১ কোটি নয়, মাত্র ১০ লক্ষ টাকা তাঁরা সারদার কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পেয়েছিলেন। মদনের যে আপ্ত-সহায়ক ওই টাকা পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন, তাঁর বয়ান ইতিমধ্যেই নিয়েছে সিবিআই। মন্দিরের অছি পরিষদের হিসাবও পরীক্ষা করা হয়েছে।

সিবিআই সূত্রের দাবি, জেরায় মদনকে প্রশ্ন করা হয়, বাকি টাকা কোথায় রাখা হয়েছিল? উত্তরে মদন জানান, তাঁর কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা পড়েনি। দল চালাতে গিয়ে ওই টাকা খরচ হয়েছে। সিবিআই সূত্রের দাবি, দল চালাতে গিয়ে কী ভাবে সারদার টাকা নেওয়া হয়েছিল, সে সংক্রান্ত অনেক তথ্য তদন্তকারীদের দিয়েছেন মদন। এক তদন্তকারীর বক্তব্য, মন্ত্রী জানিয়েছেন, দল পরিচালনায় তৃণমূলের সব নেতাই দায়বদ্ধ। আর দল পরিচালনা করতে গেলে টাকার প্রয়োজন। কোনও না কোনও ভাবে টাকা জোগাড় করতে হয়। সেই বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল। চার দেওয়ালের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের যখন এই ছবি, বাইরে তখন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই পাল্টা আক্রমণে যেতে হচ্ছে তৃণমূলকে। এ দিনই রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে গিয়ে সিবিআই এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন রাজ্যের পাঁচ মন্ত্রী। তাঁদের আপত্তি ক্রীড়ামন্ত্রীকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া নিয়ে। রাজভবন থেকে বেরিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী বা স্পিকার যেমন মদনের গ্রেফতারির খবর আগাম জানতেন না, তেমনই সরকারের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালও জানতেন না। যদিও এঁদের কাউকেই আগাম গ্রেফতারির কথা জানানো আইনত বাধ্যতামূলক নয়। পার্থবাবুর আরও অভিযোগ, “আমরা গরিব হতে পারি। কিন্তু আমাদের সম্মান আছে! সিবিআইকে সামনে রেখে তৃণমূলকে দুরমুশ করা হচ্ছে!” পার্থবাবুদের কাণ্ড দেখে সিপিএমের আইনজীবী এবং কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি ওঁদের বাঁচাতে পারবেন না! বেআইনি কিছু হলে আদালতে গিয়ে বলছেন না কেন?”



মন্তব্য চালু নেই