ডাক্তারদের জন্য ব্যতিক্রমী প্রশিক্ষণ
হাসতালে বেডে অথবা অপারেশনের টেবিলে যে কোন রোগীর মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু অনেক সময় তা মানতে না পেরে ডাক্তারের ওপর চড়াও হন রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা। এমনকি হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভের ঘটনাও দেখা যায়। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কী করবেন সেই ডাক্তার? কী ভাবে সামলাবেন পরিস্থিতি? তাঁর আচার-আচরণই বা কেমন হবে?
এতদিন বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশই মনে করে, তাত্ত্বিক পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের এমন নানা জরুরি বিষয় সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ জরুরি।
সে কথা মাথায় রেখেই এবার ভারতের ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে (এসএসকেএম হাসপাতাল) তৈরি হল একটি অভিনব গোষ্ঠী, যার নাম ‘আইপিজিএমইআর পজিটিভ’।
হাসপাতালে রোগীর পরিজনদের সঙ্গে, জুনিয়র ডাক্তারদের ব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষদের লাগাতার অভিযোগ, কথায় কথায় উভয়পক্ষে মারপিটে জড়িয়ে পড়া, তার জেরে হাসপাতালে কর্মবিরতি। ক্রমাগত এমন চলতে থাকায় তিতিবিরক্ত স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা। সেই পরিস্থিতিতে এসএসকেএমের এমন উদ্যোগ তাঁদের সামনে এক ঝলক তাজা হাওয়া বলেই মনে করছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্ট দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চারপাশের নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে এক জন চিকিৎসক কী ভাবে নিজের মাথা ঠান্ডা রেখে কর্তব্যে অবিচল থাকবেন, তারই রূপরেখা তৈরি করছে ওই গোষ্ঠী।’
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে একাধিক বার জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আরও সংবেদনশীল করে তোলাটা জরুরি। কী ভাবে তা সম্ভব, তা স্থির করার জন্য স্বাস্থ্যকর্তাদের একাধিক বার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এসএসকেএমের এই উদ্যোগ গোটা রাজ্যের জন্যই জরুরি বলে মনে করছে স্বাস্থ্য দফতর।
কিছু দিন আগেই রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এমন একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। তাতেও সাড়া মিলেছিল। কিন্তু সকলে বলেছিলেন, এক-আধ দিনের কর্মশালা নয়, সমস্যা মেটাতে নিরন্তর চেষ্টা দরকার। মূলত সেই চেষ্টার প্রয়োজনীয়তাকেই উস্কে দিয়েছে এসএসকেএম।
এই হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসকদীপ্তেন্দ্র সরকারের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে আইপিজিএমইআর পজিটিভ। মেডিক্যাল পড়ুয়া থেকে শুরু করে জুনিয়র ডাক্তারদের যে কেউ এই গ্রুপে শরিক হতে পারেন।
ভারতীয় সংবাদপত্র জানিয়েছে, এসএসকেএমে তৃণমূল কংগ্রেস ও ডিএসও সমর্থকরা বিভিন্ন ঘটনায় বারবার বিবাদে জড়িয়ে পড়লেও এই গ্রুপে তাঁদের অনেকেই শরিক হয়েছেন। অন্য হাসপাতালের ডাক্তারেরাও চাইলে শরিক হতে পারছেন এই গ্রুপে।
দীপ্তেন্দ্রবাবু জানান, গ্রুপের কাজকর্মের শুরুই হয়েছিল ‘কমিউনিকেশন স্কিল’ অর্থাৎ, যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা তৈরি করার মাধ্যমে। সাম্প্রতিক বিষয়ের উপরে একটি কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করা হয়েছিল। এক রোগীর মৃত্যুর পরে তাঁর বাড়ির লোকজন চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে চ়ড়াও হয়েছেন হাসপাতালে। কী ভাবে তা সামলানো সম্ভব?
তিনি বলেন, ‘‘এক-এক জন ডাক্তার এক-এক রকম ভাবে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন। আর তার থেকে নিজেরাই ক্রমশ বুঝতে পেরেছেন, কোনটা ঠিক। কখনও কখনও ডাক্তারদেরই নিজেদের রোগীর বাড়ির লোক ভেবে সেই চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হয়েছে। সেটা করতে করতে ওঁরা নিজেরাই কেমন যেন সেই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছেন। অন্যের জুতোয় পা গলিয়ে দেখার চেষ্টাটা কতটা জরুরি, তা আমরা হাতেনাতে টের পাচ্ছি।’’
হাসপাতালের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের প্রধানেরাই এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
শুধু হাসপাতালের গণ্ডগোল নয়, মেডিক্যাল পাঠ্যক্রমে আর কী কী থাকলে ভাল হত, লেকচার ক্লাসগুলি কেন প্রায়শই একঘেয়ে হয়ে ওঠে, শিক্ষক-চিকিৎসকদের সামনে বসে এমন নানা বিষয়েও মতামত ভাগ করে নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানও আয়োজন করেছেন তাঁরা।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, কিছুদিনের মধ্যেই এই গ্রুপের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল পড়ুয়াদের সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে মেডিক্যাল পড়ুয়ারা এসে ভাগ করে নেবেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা।
এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এই উদ্যোগ যদি রাজ্যের অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে এর তাৎপর্যটাও অনেক বাড়বে।
মন্তব্য চালু নেই