ট্রাম্প প্রশাসন দেশ চালাবে ’অল রাইটে’!
সদ্য নির্বাচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনে শীর্ষ সরকারি কর্মচারী বা চিফ অফ স্টাফ হিসেবে আরএনসি চেয়ারম্যান র্যান্স পিয়ারিবাসের নাম ঘোষণা করেছেন। আর রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলগত দিক দেখবেন তারই নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করা ডানপন্থী সংবাদকর্মী স্টিফেন ব্যানন। স্টিফ ব্যাননের আরেক পরিচয় তিনি ’অল রাইট’ মুভমেন্ট এর নায়ক। তবে অল রাইট মানে ’সব ঠিক’ বোঝায় না। যুক্তরাষ্ট্রে এটা বোঝায় সব কিছুতেই ডানপন্থা বিবেচনা।
এর বাইরে বিচারমন্ত্রী বা অভিবাসন দেখভাল করার জন্য বড় পদ পাচ্ছেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি, দায়িত্ব নেবেন এটর্নি জেনারেল হিসেবে। সেক্রেটারি অফ স্টেট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক হাউস স্পিকার নিট গ্রিনরিচের নামে এসেছে। যিনি শুরু থেকেই ট্রাম্পের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং ট্রাম্পকে রোনাল্ড রিগানের মতোই একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিত্রিত করছিলেন গণমাধ্যমে। এর বাইরে নিরাপত্তা মন্ত্রী হিসেবে নাম এসেছে জেনারেল ফ্লিনের। যিনিও ট্রাম্পের মতোই ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিধনে পারমানবিক বোমার সমাধানে বিশ্বাসী। এসব নিয়োগের আলোচনার মধ্যেই চলছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্ভাব্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের নানা পরিকল্পনা।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিরাট সংখ্যক আনডকুমেন্টেড বা কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে চান নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সিবিএস এর সিক্সটি মিনিটকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে ঠিক কতো সংখ্যক মানুষকে বিতাড়িত করবেন ট্রাম্প, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি। তবে এই সংখ্যা ৩ মিলিয়ন বা প্রায় ৩০ লক্ষাধিক বলে বলছে গণমাধ্যমগুলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করেই ছাড়বেন। কিন্তু সেটা পুরোটা দেয়াল না হয়ে কিছু কাঁটাতারের বেড়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ডিপোর্টেশন (অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ণ) সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সমর্থক, ভবিষ্যত সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে যার নাম আসছে সেই নিট গ্রিনরিচ বলছেন, প্রায় ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ মানুষকে এখন ডিপোর্ট করার পরিকল্পনা চলছে। এই ২০ লাখ মানুষের সংখ্যাটাই অনেক বেশি উল্লেখ করে গ্রিনরিচ বলছেন, দাগী আসামী এবং অপরাধ করেছে এমন মানুষ এই তালিকায় পড়বে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতির মূল ইস্যু দুটি। একটি অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ণ অন্যটি মুসলিম প্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। এই দুটি বিষয়কে নিয়ে সামনে যদি সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া হয় তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ’জমদূত’ হিসেবে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন হিলারি আর ট্রাম্প উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। একটি নতুন বই প্রকাশ করেছেন স্যান্ডার্স, যার নাম দিয়েছেন আওয়ার রেভুলেশন বা আমাদের সংগ্রাম। সেই বইটি নিয়ে আলোচনা করতে এসে সিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে স্যান্ডার্স বলেন, অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের এখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তবে সে যদি আগের মতো অবস্থান ধরে রেখে মাইনোরিটি স্টিম রোলার চালানোর পথে অগ্রসর হয় তাহলে আমরা দূর্বার প্রতিবাদ অব্যহত রাখব।
সেই পথেই আগাচ্ছে ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলন। নির্বাচনের রাত থেকে টানা ৫ম দিনের মতো চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ। এগুলো ট্রাম্পের কাছের লোকজন বর্ণনা করছেন ভাড়াটিয়াদের প্রতিবাদ হিসেবে। ট্রাম্প নিজেও প্রথমে টুইটারে এমন মন্তব্য করার পর চারিদিকে আরো ক্ষোভ ফুটে ওঠার পর সুর সামলে নিয়েছেন। ট্রাম্পের শীর্ষ নির্বাচনী প্রচারণা সহযোগী ক্যালিয়েন কনওয়ে বলেছেন, হিলারি আর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উচিত হবে এই প্রতিবাদ থামিয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। তবে যেসব বিষয় নিয়ে প্রতিবাদকারীদের মনে শঙ্কা আর ক্ষোভ সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে আরো আগ্রাসী কথাবার্তায় এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমে যাবে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যে তার নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী কাজ করবেন সেটা বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা সম্ভাব্য ব্যক্তিবর্গের তালিকা দেখে।
র্যান্স পিয়ারিবাস সাবেক উইসকনসিনের জিওপি চেয়ারম্যান থেকে সদ্য তিনি জাতীয়ভাবে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (আরএনসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ট্রাম্পের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিলেন। এমনকি ওয়াশিংটন ডিসির সব বাঘা বাঘা শীর্ষ রাজনীতিক যখন ট্রাম্পকে পাশে বসিয়ে রেখে অন্য কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কথাবার্তা বলছিলেন তখনও পিয়ারিবাস ট্রাম্পের সমর্থনে নীরবে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। আর স্টিফ ব্যানন কট্টর ডানপন্তী বা হোয়াইট সুপ্রিমেসির প্লাটফর্ম বারব্রিট ডটকমের সাবেক সম্পাদক হিসেবে বেশ সমালোচিত উদার রাজনৈতিক মহলে। ধারণা করা হয়, ট্রাম্প একনিষ্ঠ ডানপন্থী রাজনীতির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্টিফ ব্যাননের কাছ থেকেই। স্টিফ ব্যানন এখন ট্রাম্পের আগামী দিনের দেশ পরিচালনার কৌশল প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। চিফ অফ স্টাফ হিসেবে র্যান্স পিয়ারিবাসের মনোনয়নে অনেকেই প্রশংসা করলেও চুপ থেকেছেন স্টিফ ব্যাননের নিয়োগে।
এখনও প্রশাসনের অনেক শীর্ষ নেতৃত্বের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। শুধুমাত্র এটর্নি জেনারেল হিসেবে নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে সাবেক হাউস স্পিকার নিট গ্রিনরিচের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধিকাংশ নীতির সঙ্গে একমত এবং কট্টর ডানপন্থার রাজনীতিক। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এতসব ডানপন্থা আর উগ্র রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির কতখানি বাস্তবায়ন করা যাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের। এরই মধ্যে ট্রাম্পের সবচেয়ে অপছন্দের ‘স্বাস্থ্য বিল’ ওবামাকেয়ারকে পুরোপুরি বাতিল করা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলছেন, নতুন বিল না আনা পর্যন্ত এটা থাকবে আর নতুন বিল আসলেও এই বিলের ভালো দিকগুলো তিনি রেখেই চমৎকার একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষার বা ইন্স্যুরেন্স প্রবর্তন করবেন তিনি। অথচ নির্বাচনের ১দিন আগেও বলেছেন নির্বাচিত হলে প্রথম কাজ হবে ওবামাকেয়ারকে বন্ধ করে দিয়ে এটা নতুনভাবে প্রতিস্থাপন করা হবে।
এসব আলোচনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অবস্থান যদি পরিবর্তন করেন তাহলে তার ভোটাররা প্রতারিত বোধ করতে পারেন। তাই ট্রাম্প কতখানি শক্ত হবেন আর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত সব বিষয়েই ভূমিকা রাখতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এমনকি হিলারি ক্লিনটনকে সাজা দেওয়ার জন্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আলাদা প্রসিকিউশন গঠন করা হবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় আছে ট্রাম্পের অর্ন্তবর্তী প্রশাসন। নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি এসিবি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলছেন, দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এবং ঐক্যবদ্ধ দেশ গড়ার জন্য অন্য অনেক কিছুই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করার প্রয়োজন রয়েছে। এসময় হিলারির বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি মাঠ গরমের চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসনের বিচারমন্ত্রী বা এটর্নি জেনারেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই ডানপন্থী নেতা।
মন্তব্য চালু নেই