গার্ডিয়ানে মন্তব্য প্রতিবেদন
ট্রাম্প কি আমেরিকাকে ধ্বংস করবেন?
সব বাধা উতরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে হোয়াইটে হাউসে প্রবেশ করবেন।
শপথ নেয়ার পর নিঃসন্দেহে তিনি হবেন বিশ্বের সবচেয়ে দাপুটে প্রেসিডেন্ট। তিনি চাইলে নিজেকে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে রুদ্রমূর্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন।
আবার চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের স্মরণীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবেন, যেমনটি তিনি বিজয়ী ভাষণে উল্লেখ করেছেন (বলেছেন, আমি সব মার্কিনির প্রেসিডেন্ট হতে চাই)।
কোন পথে যাবেন ট্রাম্প? তিনি কি আমেরিকাকে ধ্বংস করবেন? এই প্রশ্নগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ৮ বছর আগে ক্ষমতায় আসেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী বারাক ওবামা। তার শাসনকালে বিশেষ করে দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকানরা প্রশাসনে খুব কমই পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। কিন্তু মার্কিনিদের মধ্যে এখন এই ধারণা খুবই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, ট্রাম্প শুধু ৪ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি।
তার ক্ষমতায় আসাটা দেশটির অগ্রগতির জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ট্রাম্পের সময়কালে আমেরিকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে এমন আশঙ্কার কথা অনেকেই প্রকাশ করছেন।
অনেকের মতো দ্য নিউ ইয়র্কারের সম্পাদক ডেভিট রেমনিক টুইটে লিখেছেন, ‘ট্রাম্পের জয় আমেরিকা প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি ট্রাজেডি (বিয়োগগাথা)। দেশের সংবিধানের জন্য ট্রাজেডি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস এবং উদার গণতন্ত্রের জন্য একটি গভীর ক্ষত। এটিকে অস্বস্তিকর ও উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে অভিহিত না করে পারা যায় না।’
ট্রাম্পকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সচেতন মহলের উদ্বেগের বেশ কিছু কারণ আছে। এর একটি হচ্ছে- গত ১৮ মাসের প্রচারণায় ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেগুলো। ট্রাম্প সেগুলোর প্রতিটি যদি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন তবে সেটি অনেকেরই জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠবে।
ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বসবাস করা ১১ মিলিয়নেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী বের করে দেবেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন। তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, অস্ত্রের লাইসেন্স আরও সহজিকরণ করবেন, এমনকি স্কুলশিক্ষকদেরও অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে দেবেন।
বলেছিলেন, গর্ভপাত বন্ধ করবেন। বলেছিলেন, ব্যক্তিগত ই-মেইল থেকে রাষ্ট্রীয় নথি চালাচালির দায়ে হিলারি ক্লিনটনকে জেলে ঢুকাবেন। বলেছিলেন, যেসব মিডিয়া তার সমালোচনা-বিরোধিতা করছে সেগুলোর লাগাম টেনে ধরবেন। মার্কিনিদের আশঙ্কা ট্রাম্প যদি এসব ক্ষেপাটে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটেন তবে উদার গণতান্ত্রিক আমেরিকার ধ্বংস বাকি থাকবে কি?
সদ্যসমাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটে, কংগ্রেসের সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এই অবিশ্বাস্য জয়ে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ক্ষমতা পেতে যাচ্ছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন, মার্কিনিরা যুগ যুগ ধরে বহু কিছুই দেখেছে তবে ভীতিকর অনেক কিছু দেখা এখনও বাকি রয়েছে।
তবে পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ আবার বলছেন, ট্রাম্প যদি তার প্রোগ্রামগুলো সত্যিই সুচিন্তিতভাবে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন তবে তিনি সত্যিকারার্থে একটি ভিন্ন আমেরিকা নির্মাণ করবেন। তিনি যদি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ধর্মীয় সমতা-বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন এবং তার পূর্বসূরির চালু করা স্বাস্থ্যসেবা নীতি (ওবামাকেয়ার) এগিয়ে নিয়ে যান তবে তিনি প্রশংসিত হবেন।
অনেকে বলছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটার টানতে অনেকেই বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সেই পথে হাঁটেন না। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। বিশেষ করে তার প্রচারণা নিয়ে বহু রেটোরিক রয়েছে। ট্রাম্পকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির ব্যক্তিগতভাবে বহুবার আঘাত করেছে।
ট্রাম্প সেগুলোর জবাবে অনেক সময় আক্রমণাত্মক ভাষণ দিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, তার সরকার পরিচালনায়ও এগুলোর প্রতিফলন ঘটবে।
শপথ নেয়ার পর ট্রাম্প চাইলেও ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। একজন প্রেসিডেন্টের বাইরে যাওয়ার সুযোগ তার নেই। প্রেসিডেন্টকে বিচার বিভাগ ও কংগ্রেসে জবাবদিহি করতে হয়। শপথ নেয়ার পর ট্রাম্পের স্বর নিম্নগামী হবে।
কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার শিবির এবং পরামর্শকরা প্রচারণার সময় ট্রাম্পকে এসব বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছে। তাকে বাস্তবসম্মত ও ইনক্লুসিব কথাবার্তা বলতে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প সে পথে হাঁটেননি। ট্রাম্প বরাবরই আক্রমণাত্মকই ছিলেন। মনে হচ্ছে ক্ষ্যাপাটে ভাবটা তার সহজাত।
মার্কিনিরা ট্রাম্পকে বিপুল সমর্থন দিয়েছেন। কংগ্রেসের সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভসে ট্রাম্পের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকছে। তিনি সেই ক্ষমতাবলে নিজেকে যদি সেভাবেই উপস্থাপন করেন তবে তা অনেকের জন্যই উদ্বেগের কারণ হবে।
ট্রাম্পের মন্ত্রিসভায় নিওট গিংরিচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনিও ট্রাম্পের মতোই আক্রমণাত্মক। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের পক্ষে তিনি।
সাংবাদিক ইভান ওসনস তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ডেমোক্রেটিকরা বিরোধিতা করলেও রিপাবলিকানরা কি মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করবে? উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই করবে। এমনকি কংগ্রেসে ভোটাভুটিতে সেই প্রস্তাব আটকে গেলেও। ২০১৯ সালে আমরা সেই দেয়াল নির্মাণ করব।
পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মতো সীমিত নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট একক ক্ষমতায়ই জনপ্রশাসনের উচ্চস্তর থেকে নিচুস্তর পর্যন্ত ৪ হাজার লোককে নিয়োগ দিতে পারেন। বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেন। সরকারের সর্বস্তরে নিজের অনুগত লোকজন নিয়োগ দিতে পারেন। মন্ত্রিসভায় বিশ্বস্ত লোকজনকে ঠাঁই দিতে পারেন।
সুতরাং ব্যুরোক্রেটরা ট্রাম্পের পদক্ষেপে বাদ সাধতে পারবে না। নতুন বছরের ২০ জানুয়ারি শপথ নেয়ার পর ট্রাম্প চাইলে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারবেন। এছাড়া ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্পের সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপ বেড়ে যাবে। তারা চাইবেন ট্রাম্প দ্রুত অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন শুরু করে দিক। এক্ষেত্রে ট্রাম্প কোন পথে যাবেন?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ বন্ধে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেবেন না। ট্রাম্পের এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে মার্কিন সংবিধানের লংঘন। কারণ সংবিধানে কোনো ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্য করার সুযোগ নেই। ট্রাম্পের আরও একটি প্রতিশ্রুতি ছিল ওবামাকেয়ার বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু এই স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতির কল্যাণে লাখ লাখ মার্কিনির হেল্থ ইন্স্যুরেন্স সুযোগ এনে দিয়েছে।
ইমেইল চালাচালির অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে জেলে ঢুকাবেন বলে প্রকাশ্যে বলেছিলেন ট্রাম্প। যদিও তিনি সেটা সরাসরি করতে পারবেন না। তবে হিলারির ওপর চাপ বাড়াতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করতে পারবেন ট্রাম্প। এসব কারণ বহু মার্কিনির আশঙ্কা ট্রাম্প কি আমেরিকাকে ধ্বংস করবেন?
জোনাথন ফ্রেডল্যান্ড
ব্রিটিশ সাংবাদিক ও গার্ডিয়ানের নিয়মিত লেখক
মন্তব্য চালু নেই