টুকরো হতে চলেছে ইয়েমেন
আজ থেকে ২৪ বছর আগে ২২ মে রিপাবলিক অব ইয়েমেন তার দুটি অংশ- উত্তর ও দক্ষিণকে একীভূত করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে দেশটিতে ঐ একীভবনকে কেন্দ্র করেই ব্যাপক মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে।
নব্বইয়ে যুক্ত হওয়ার পর থেকে এ যাবত, দেশটির ইহজাগতিক রাষ্ট্রচিন্তারমুক্তমনা, গোঁড়া ধার্মিক, সংস্কারপন্থী ধার্মিক, আদিবাসীসহ প্রত্যেকটি গোষ্ঠিকেন্দ্রেরচাপে ক্রমশ প্রান্তিক গোষ্ঠির মতো দুর্বল হয়ে পড়ছে এমন অভিযোগ তুলে আসছে। আর এমন মনোভাব গোটা জাতিকে কেন্দ্র সানার প্রতি ক্রমশ সামষ্টিকভাবে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে।
একটু পিছন ফিরলেই দেখা যাবে, নব্বইয়ে দেশটির দুটি পৃথক অংশের ক্ষমতায় ছিল দুটি পৃথক ভাবধারার দল, যাদের আদর্শের অনেকাংশ ও ক্ষমতার ধরনে ছিল ভিন্নতা। একইসঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, সে সংক্রান্ত পরিকল্পনায়ও পার্থক্য ছিল। উত্তরাংশের ক্ষমতায় ছিল সামরিক কর্তাব্যক্তিরা। আর দক্ষিণের ক্ষমতায় ছিল ইহজাগতিক রাষ্ট্রচিন্তার সমাজতন্ত্রবাদীরা। এই দুটি দল দেশের দুটি অংশকে এক করলো ঠিকই, কিন্তু মাত্র ৪ বছরের মধ্যে, ২১ মে, ১৯৯৪ সালে, বিরোধ দেখা দিল।
ইয়েমেনের দক্ষিণাংশ পুনরায় পৃথকীকরণ চাইলো। অসম ক্ষমতা বিন্যাসের কারণে এটা অনেকটাই অবধারিত ছিল।বিরোধ শুরু হওয়ার পর কোন শান্তিকামী সমঝোতায় দেশটি উপনীত হতে পারলো না। এমন অবস্থায় সামরিক মগজ যে পথে সাধারণত চিন্তা করে থাকে, সে পথেই চিন্তা এগোলো কেন্দ্রের। সাবেক উত্তরাংশসহ তৎকালীন সমগ্র ইয়েমেনের অধিকর্তা রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ তখন দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে চাইলেন। ইয়েমেনের ইতিহাসে কুৎসিততম নারকীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। ৭ হাজার মানুষ মারা গেলো। এ ঘটনার পর ইয়েমেন একথেকে গেলেও, গণহত্যার ক্ষত শুকোলো না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তর ইয়েমেন ১৯১৮ সালের ১ নভেম্বর তুরস্কের ওসমান (অটোমান) সম্রাটদের শাসন থেকে স্বাধীনতা পায়। দক্ষিণ ইয়েমেন তখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে তাদের অধীনে। পরে ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দক্ষিণ। দীর্ঘদিন পৃথক থাকার পর ১৯৯০ সালের ২২ মে দেশটির দুই অংশ একীভূত হয়, আগেই বলা হয়েছে। এই একীভবনের পর ইয়েমেন গণতান্ত্রিক উপায়ে শাসনতন্ত্র চালু হতে পারতো। কিন্তু তা না হয়ে সামরিক প্রধান আলি আব্দুল্লাহ সালেহ পেশিশক্তিতেজোড়া ইয়েমেন হয়ে গেলো তার একক ক্ষমতা প্রদর্শনের স্থান।
দক্ষিণে বিদ্রোহ জাগে মূলত এ কারণেই। অবশ্য ৩০ বছর পরে হলেও আব্দুল্লাহ সালেহকে ধসানো গেল। আর মিলিত ইয়েমেনে ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর আবারও সুযোগ এলো একটি যৌথ ও সার্বিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করার। কিন্তু দেখা গেলো, দক্ষিণের মানুষ তখনও পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে চেপে রেখেছে। দক্ষিণ ইয়েমেনের কিছু কিছু অংশে ১৯৯৪ সালের ২১ মে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হতো বেশ আগে থেকেই। বর্তমানে জাতিসংঘের অধীনস্থ ন্যাশনাল ডায়ালগ কনফারেন্স সর্বসম্মতিক্রমে দেশটিকে ৬টি পৃথক প্রদেশে ভাগ করে দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিল।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছিল দেশটিতে। ৬ পৃথক প্রদেশের আলাদা আলাদা সংসদ, আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে। অর্থাৎ প্রতিটি প্রদেশের জন্যে পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসন রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে দক্ষিণের মানুষের দাবির ওপর ভিত্তি করে সে দেশে অধিক স্বায়ত্বশাসনের সুযোগ দিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের সন্তোষে রাখার কথা ভাবা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ঠিক হয়েছিল ৬ প্রদেশের মধ্যে মাত্র ২টি গঠিত হবে দক্ষিণাংশে। বাকি ৪টি গঠিত হবে উত্তরাংশে। কিন্তু এসবে সন্তুষ্ট ছিল না দক্ষিণ, এ ধরনের ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় আস্থা রাখতে অপারগ ছিল তারা। তাদের দাবি সম্পূর্ণরূপে পৃথক রাষ্ট্র।
এমনই অস্থিত যখন ইয়েমেন, তখন উত্তরে ক্রমশ বেড়ে চলেছে শিয়া সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠির প্রভাব বিস্তারের অভিযান। আর দক্ষিণে সশস্ত্র ইসলামি দল আল কায়েদার প্রভাববিস্তারী তৎপরতা। পূর্ব থেকেইদেশের আভ্যন্তরীণ অসংখ্য সমস্যা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত এবং ধর্মীয়, আদিবাসী ও সমাজতন্ত্রবাদী নেতারা সহস্র ‘অসমতার’ ও ‘অবিচারের’ সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তাদের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে। সব মিলিয়ে ভাঙনের সুর, দ্বন্দ্ব, রক্তাক্ত সংঘাত দেশটির পূর্নাঙ্গ অস্তিত্বকে করে তুলেছে প্রশ্নবিদ্ধ, জাতিগত একতাকে করে তুলেছে অন্য যে কোন জাতির তুলনায় অনেক বেশি ভঙ্গুর।
মন্তব্য চালু নেই