জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুঃসাহসী প্রতিরোধ
আজও রাজধানীর সকল সরকারি-বেসরকারি বাসভবন এবং যানবাহনে কালো পতাকা উড্ডীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশানুযায়ী বিভিন্ন সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে। স্বাধিকার আদায়ের দাবি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার সমর্থনে রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত থাকে।
১৯৭১-এর এই দিনটি ছিল শুক্রবার। আজ ছিল লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের আঠারতম দিবস। একদিন বিরতির পর আজ সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আজকের আলোচনা ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়। আজও আলোচনা চলে ওয়ান টু ওয়ান অর্থাৎ তৃতীয় কেউই উপস্থিত ছিলেন না।
আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আমরা আগামীকাল সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে পুনরায় আলোচনা বৈঠকে বসব। তৎপূর্বে উপদেষ্টা পর্যায়ে সন্ধ্যায় আমার প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।’
আজকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে- এইদিনে দুঃসাহসী প্রতিরোধ গড়ে জনতা। দুপুর আড়াইটায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদে জয়দেবপুরে প্রায় ১০ হাজার লোক এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ এ মিছিলটি চৌরাস্তা ও রেলগেটের নিকট অবস্থান গ্রহণ করলে বিনা উস্কানিতে সেনা সদস্যরা জনসাধারণের ওপর গুলিবর্ষণ ও এলোপাতাড়ি বেয়নেট চার্জ করে। ফলে ঘটনাস্থলে ৯ জন এবং পরে আরও ১১ জনের মৃত্যু ঘটে এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও রেলগেটের কাছে জমায়েত হওয়া হাজার হাজার লোকের ওপর গুলিবর্ষণের এই সংবাদে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে লক্ষ মানুষ ছুটে আসে এবং সড়ক অবরোধ করে। তারা বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এ বর্বরোচিত হামলার বিচার দাবি করতে থাকলে সেনাবাহিনী পুনরায় ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে।
অপরদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের বাঙালী সৈনিক ও কর্মকর্তারা এদিন তাদের উর্ধ্বতন পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নিরস্ত্র করার ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
এ সময় কিছু গোলাগুলি হলে আশপাশের গ্রামবাসী স্থানীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হক ও আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালী সৈনিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনাটি ছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালেই স্বাধিকারের দাবি আদায় না হলে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর বিকেলে জয়দেবপুরে সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র নাগরিকদের নির্বিচারে গুলি করে হতাহত করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেন, ‘যারা মনে করেন যে, বুলেট বা শক্তিপ্রয়োগের দ্বারা গণআন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে, তারা আহাম্মকের স্বর্গে বসবাস করছেন।’
সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছে যে, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাই যদি সত্য হয় তবে জয়দেবপুরে এক বাজারে গিয়ে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালাল কিভাবে? ঢাকায় অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আমি এ ঘটনার জবাব চাই।’
এদিন ঢাকার সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পেট্রোভ ভলটিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তার সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার ও জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন।
আজ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ইয়াহিয়া খান যদি মুজিবের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে তবে সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবকে আহ্বান জানাই।’
আজ স্বাধিকারের দাবিতে সেনাবাহিনীর গুলিতে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন সেসব বীর শহীদদের স্মরণে এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করে বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই