ইয়াহিয়াকে ভাসানী, ‘লা-কুম দ্বী-নুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’

একাত্তরের এই দিনে ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সেখানে জটলা, মিছিল, মিটিং চলতেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চলে বিভিন্নস্থানে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি।

অগ্নিঝরা মার্চের আজ নবম দিন। কার্যত একাত্তরের এই দিনে মিছিলে মিছিলে উত্তাল ছিল সারাদেশ। চরমে পৌঁছে দেশব্যাপী চলা লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর উত্তাল-অগ্নিগর্ভ দিনগুলোর একটি।

একাত্তরের ৯ মার্চ ছিল মঙ্গলবার। এদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বর্ষীয়ান মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলেন, ‘শেখ মুজিব নির্দেশিত মার্চের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের ন্যায় আন্দোলন শুরু করব।’

তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। লা-কুম দ্বী-নুকুম, ওয়ালিয়া দ্বীন (অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার আমার ধর্ম আমার)।’

পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর এই বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ টেলিফোন আলাপ হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পাক হানাদাররা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেই অনুযায়ী চলছে বাংলাদেশ। পুরো বাংলাদেশ চলছে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে, নির্দেশে। শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার।

বাংলাদেশের যুবকদের রক্তে তখন একই নেশা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দু’চোখে দেশকে হানাদারমুক্ত করার স্বপ্ন। বাঙালিদের নতুন একটি দেশ। বাঙালির হৃদয়ে শুধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। তাই তাদের রক্তে বইতে থাকে টগবগে উত্তেজনা। শুধু অপেক্ষা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের।

এদিকে সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চরমে পৌঁছে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এ বাংলায় তাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। পাক সামরিক জান্তার কোন নির্দেশ কেউ-ই মানে না। এ জনপদের প্রতিটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। এমনকি শুধু ক্যান্টমেন্ট ছাড়া পাক সামরিক জান্তা ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করতে মুখের ওপর ‘না’ বলতে থাকে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এদিকে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। সভায় কয়েকদিনের আন্দোলনে নিহতদের, বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ইকবালসহ অন্যদের স্মরণে এক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়।

এদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সারাদেশ ছিল অচল। সরকারী-আধাসরকারী স্বায়ত্তশাসিত অফিস, আদালতের কর্মীরা হরতাল পালন করেন। যেসব অফিস জরুরী প্রয়োজনে খোলা রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল সেসব অফিস নির্দেশনানুযায়ী খোলা ছিল।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সরকারী, বেসরকারী, বাসাবাড়িতে কালো পতাকা উড্ডীন ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নির্দেশে ব্যাংক-বীমা দফতরসমূহ সকাল সাড়ে ৯টা হতে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা ছিল এবং এ সময়ে কড়া নজরদারি ছিল যাতে কোন টাকা-পয়সা পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে না পারে।

অসহযোগ আন্দোলনে নিহত-আহতদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিদিন অর্থ-খাদ্য-রক্ত সাহায্য দিতে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস এবং মেডিক্যাল কলেজসমূহের সামনে লাইন দিচ্ছে।

ততদিনে ঢাকা শহরসহ দেশের প্রায় ৬০-৭০টি স্থানে গোপন এবং প্রকাশ্য সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নেতার নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারাদেশে প্রতিদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গড়ে উঠতে থাকল।



মন্তব্য চালু নেই