বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের হিড়িক

একাত্তর সালের এ সময়টা ছিল চরম উত্তাপ ছড়ানো। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই বিস্ফোরণের দিকে ধাবমান। যে কোনো সময়েই ঘটে যেতে পারে বড় ধরণের অঘটন। এ উপলব্ধি থেকে বিদেশিদের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। আজকের এইদিনে ৪৫ জাতিসংঘ কর্মীসহ ২৬৫ বিদেশি নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন। অন্যদিকে এভাবে বিদেশিদের দেশত্যাগ ছিল ঢাকায় আসন্ন গণহত্যারই ইঙ্গিত।

১৯৭১-এর ১৩ মার্চ ছিল শনিবার। এদিনটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ষষ্ঠ দিবস। যথারীতি আজো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি, আধাসরকারি অফিস-আদালত কর্মচারীদের অনুপস্থিতির জন্য বন্ধ থাকে। বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ বেধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী স্বাভাবিকভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। স্বাধীকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শোক এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে আজো সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, বাসভবন এবং যানবাহনে কালো পতাকা উত্তোলিত থাকে।

এদিন সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌ-পরিবহন, ডাক, পাটকল এবং সুতাকলের শ্রমিক সংগঠনসমূহ এবং ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সকল আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করে।

অপরদিকে সমগ্র পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি এবং কাইয়ুম মুসলিম লীগ ব্যতীত অন্য সব রাজনৈতিক দল যেমন ন্যাপ (ওয়ালী), ন্যাপ (ভাসানী), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন লীগ, ইস্তেকলাল পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও জমিয়তে ওলামায়েসহ অন্য দলগুলো এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।

পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যালঘু দলগুলোর এক যৌথ সভা আজ লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যালঘু দলসমূহের সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, ‘বর্তমান সঙ্কটের মূল কারণ হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। আমরা মনে করি যে, অবিলম্বে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় গিয়ে দ্রুত সব প্রকার অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও মতদ্ধৈততা দূর করে, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনে, আন্তরিকভাবে ও মুক্ত মনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৪টি শর্ত মেনে নিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আলোচনা শুরু করবে। অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করার যথাযথ পরিবেশ তৈরি করবে।’

সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেছিলেন এ সভায় গৃহীত প্রস্তাবটি এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

দৃশ্যত, সমগ্র পাকিস্তানে মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তানের সংহতি রক্ষাকল্পে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানে দাবি ওঠে প্রেসিডেন্ট যেন অবিলম্বে ঢাকা যান। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সব দাবি নিঃশর্তভাবে মেনে নেন।

এসব সত্ত্বেও সামরিক সরকার সর্বব্যাপী রাজনৈতিক গণমতকে উপেক্ষা করে নয়া এক সামরিক ফরমান জারি করে। ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর হতে ১১৫ নম্বর সামরিক আদেশে বলা হয়, ‘প্রতিরক্ষা খাতের বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারীদের আগামী ১৫ মার্চ সকালের মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। যারা উক্ত তারিখের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হবেন, তাদের ছাঁটাই করা হবে এবং পলাতক হিসেবে তাদের সামরিক আদালতে বিচার করাও হতে পারে।

দেশরক্ষা বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- এমইএস, কম্বাইন্ড ওয়ার্কশপ, অস্ত্রাগার, সিএমএ, এলএও, সিএসডি, বিদ্যুত ও পানি সরবরাহ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার সব বেসামরিক কর্মচারী, যারা প্রতিরক্ষা খাত হতে বেতন পেয়ে থাকেন তাদের ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে স্ব স্ব বিভাগের নিকট কাজে যোগদানের ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হবে। যদি কেউ উক্ত সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হন তবে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে এবং পলাতক হিসেবে সামরিক আদালতে বিচার করে সামরিক আইনের ২৫নং বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছর সশ্রম কারাদ- দেওয়া হবে।’

জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক কর্তৃক জারিকৃত এ ফরমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় গর্জে উঠে বলেন, ‘সামরিক আইনের আর একটি অধ্যাদেশ জারি হয়েছে জানতে পেরে আমি বিস্মিত হয়েছি। আজ যখন সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য ইতোমধ্যেই বাংলার সমগ্র গণমানুষের প্রচণ্ড দাবির কথা আমরা ঘোষণা করেছি, তখন নতুন করে এরূপ আদেশ জারি করা জনসাধারণকে উস্কানিদানেরই শামিল। এ ধরনের আদেশ যারা জারি করছেন তাদের এ সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত যে, আজ জনসাধারণ তাদের ইস্পাত কঠিন সঙ্কল্পে ঐক্যবদ্ধ। এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না। সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমি এ ধরনের তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।’



মন্তব্য চালু নেই