মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘ডালিম হোটেল’

চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিঅ্যান্ডটি অফিসের পেছনের সড়কে এক হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন ‘মহামায়া’ ভবনটি একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা কেড়ে নিয়েছিল। নাম দিয়েছিল ‘ডালিম হোটেল’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই ডালিম হোটেলই ছিল চট্টগ্রামে আলবদর ও রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতনকেন্দ্র। এ বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্রে আলবদরদের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালি। চট্টগ্রামের নানা শ্রেণীপেশার শত শত মানুষকে ধরে এ ভবনে এনে পৈশাচিক নির্যাতনে মেতে উঠত কাসেম আলী ও তার অনুসারীরা। আমৃত্যু চলত এ নির্যাতন। একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি মীর কাসেম আলী ছিলেন জেলা আলবদর বাহিনীরও প্রধান। ওই সময় তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন চট্টগ্রামের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা।

মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে ১৪টি অভিযোগ আনা হয় সেগুলোর মধ্যে ১২টিই মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে ডালিম হোটেলের টর্চার সেলে নির্যাতন ও হত্যা। নির্যাতনে অনেকেই মারা যেতেন অথবা কাউকে মেরে ফেলার জন্যই চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। ডালিম হোটেলের নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠেন নির্যাতনের শিকার জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা। মীর কাসেম আলীর নির্দেশে একাত্তরে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে ইলেকট্রিক শক, ঝুলিয়ে পেটানো, শরীরের বিভিন্ন স্থানে থেঁতলে দেওয়া, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করাই ছিল বদর বাহিনীর কাজ।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীর রায়ের পর্যবেক্ষণে ডালিম হোটেলকে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হত্যা ও নির্যাতনের অপরাধে মীর কাসেমকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, ”আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে ডালিম হোটেলে ধরে নিয়ে আসত। এটা প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদর সদস্যদের পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজে। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই ছিল একটি ‘মৃত্যুর কারখানা’।” রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ”ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সব ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সব কিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী তিনি ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের’ দোষে দোষী।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর মামলায় ২৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মুহম্মদ ইমরান, সানাউল্লাহ চৌধুরী, সুনীলকান্তি বর্ধণ, শিবু দাশ, মৃদুল কুমার দে, প্রদীপ কুমার তালুকদার, মুক্তিযোদ্ধা ইস্কান্দার আলম চৌধুরী, ছুটু মিয়া, জাকারিয়া, মো. হাসান, গোলাম আলী, জামালউদ্দিন, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী প্রমুখ।

মানিকগঞ্জের বাসিন্দা মীর কাসেম আলীর বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম নন্দনকাননের টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মচারী। সেই সুবাদে কাসেম মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী মিলিশিয়া হিসেবে গঠিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। এই আলবদর বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ড ছিলেন মীর কাসেম আলী। প্রথম কমান্ড ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। মীর কাসেমের নির্দেশে একাত্তরে ডালিম হোটেল হয়ে ওঠে বদর বাহিনীর টর্চার ক্যাম্প। চট্টগ্রামের গুডস হিল, কর্ণফুলী নদীর পাড়ে চাকতাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর পৃথক নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।

মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসে। সেখানে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর তার এবং আরও পাঁচজনের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।

মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ধরা পড়েছিলেন আলবদর বাহিনীর হাতে। সেদিন থেকেই ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় তাকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন, ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে অন্য বন্দিদের সঙ্গে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। অন্য বন্দিদের সঙ্গে তাকেও অবর্ণনীয় মারধর করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য আদায় করার চেষ্টা চালায় আলবদররা। ওই নির্যাতনের মূল হোতা ছিলেন কাসেম আলী।

একাত্তরে ওই নির্যাতনকেন্দ্রে ২৩ দিন বন্দি ছিলেন তখনকার চট্টগ্রাম জয়বাংলা বাহিনীর উপপ্রধান মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ২৩ নভেম্বর কদমতলীর বাড়ি থেকে তাকে ধরে এনেছিল আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। ওই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মীর কাসেমের উপস্থিতিতেই আলবদর বাহিনীর সদস্যরা লোহার চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইত। নির্যাতনের সময়ে বা পরে বন্দিরা পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হতো।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে নিয়ে গিয়ে নানাভাবে পেটানো হতো। প্রায় সব কক্ষ থেকেই দিনের বিভিন্ন সময়ে গোঙানি ও আর্তনাদের আওয়াজ পাওয়া যেত।’ তিনি বলেন, মীর কাসেম যখন ডালিম হোটেলে আসতেন, তখন বদর সদস্যরা পাহারায় থাকা অন্যদের বলত, ‘কাসেম সাব আ গেয়া, তোম লোক বহুত হুঁশিয়ার।’ তিনি আসার পর বন্দিরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন।

ডালিম হোটেলের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী আরও জানান, ডালিম হোটেলে নিয়ে তার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। রাজাকাররা ইলেকট্রিক শক দিত। পা ওপরে, মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে চোখ বেঁধে পেটানো হয়েছিল। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হতো।

নির্যাতিত সানাউল্লাহ চৌধুরী জানান, একাত্তরের ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যার পর বাসা থেকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত-আটজন অস্ত্রধারী তাদের চোখ বেঁধে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসে। সেখানে দোতলায় আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। এ সময় ওপর তলা থেকে নির্যাতনের আওয়াজ আসে। এ সময় শফিউল আলম কানে কানে জানান, ইনি মীর কাসেম আলী, বাংলা খান। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার।

মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী জানান, ডালিম হোটেলের একটি কক্ষে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় আলবদর সদস্যরা। জিজ্ঞাসাবাদে সুবিধা করতে না পেরে এক পর্যায়ে তার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে যায়। এরপর মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা তাকে বেদম পেটায়। তারা লাঠি, লোহার রড ও ইলেকট্রিক তার দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিল। নির্যাতনের শিকার লুৎফর রহমান ফারুক জানান, মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ডালিম হোটেলে নির্যাতনের কারণে পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েন তিনি। আজীবনের জন্য তিনি সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেমকে হত্যা ও নির্যাতনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অপহরণ ও ডালিম হোটেলে আটক রেখে নির্যাতনের দায়ের মীর কাসেমকে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায় বাতিল চেয়ে আপিল করা হলে গত ৮ মার্চ ফাঁসি বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।



মন্তব্য চালু নেই