চরের জমি পড়ে খায় বরিশালের চরাঞ্চলবাসীর রাত কাটে আতংকে

“নদীর এপার ভেঙ্গে ওপার গড়ে-এইতো নদীর খেলা, সকাল বেলা বাদশা তুমি ফকির সন্ধ্যা বেলা” এ প্রবাদ বাক্যের বাস্তব রূপ মিলেছে নদী বেষ্টিত এবং ভাঙ্গণ কবলিত বরিশাল সদর উপজেলাসহ মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলের বিস্তির্ন জনপদ ঘুরে। এসব উপজেলা ঘেঁষেই রয়েছে উত্তাল মেঘনা, কালাবদর, জয়ন্তী, সন্ধ্যা, সুগন্ধ্যা, কীর্তনখোলা ও আড়িয়াল খাঁ নদী।

বিস্তির্ন জনপদের জীবন সংগ্রামী মানুষের দেওয়া তথ্য মতে, এসব নদীর তীরবর্তী একপাড়ের বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন নদী ভাঙ্গণে গ্রাস করে নিলেও অপরপাড়ে জেগে ওঠা চরের জমি ভোগদখল করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। যারাওবা জেগে ওঠা চরের কিছু অংশ দখল করে মাথাগোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য বসত ঘর নির্মান কিংবা পরিবারের দু’মুঠো আহারের জন্য চাষাবাদ শুরু করেছেন তাদেরও দখলবাজ প্রভাবশালীদের ভয়ে রাত কাটে চরম আতংকে। এনিয়ে মামলা ও লাঠিয়াল বাহিনীর হামলা নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ভুক্তভোগী চরাঞ্চলবাসী। মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চরকালেখা ইউনিয়নের ভূক্তভোগীদের দেয়া তথ্যমতে, ইউনিয়নের উত্তর গাছুয়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভয়ঙ্কর জয়ন্তী নদী। গত ১৭ বছর পূর্বে নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে গ্রামটি। ফলে নিঃস্ব হয়ে যায় ওই গ্রামের সহস্রাধীক পরিবার। যারমধ্যে আজো মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজে পায়নি ওই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের সদস্যরা। দীর্ঘদিন পর সেই নিশ্চিহ্ন গ্রামে গত ৫ বছর পূর্বে জেগে উঠেছে চর।

এ যেন অসহায়, নিঃস্ব মানুষদের জন্য সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। জেগে ওঠা চরের মধ্যে ইতোমধ্যে বসত ঘর উত্তোলন করে বসবাস করছেন নিঃস্ব হওয়া কয়েকটি পরিবার। কিন্তু তাতে দেখা দিয়েছে চরম বিপত্তি। জেগে ওঠা চরের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পরে পাশ্ববর্তী গ্রামের প্রভাবশালী কতিপয় ভূমিদস্যুদের। তারা নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে চর দখলের জন্য একাধিকবার চেষ্ঠা করেও ব্যর্থ হয়। ওইসব প্রভাবশালীদের বাঁধা দিতে গিয়ে তাদের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীর একাধিকবার হামলা ও মিথ্যে মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘদিন আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওই গ্রামের শিক্ষক, সমাজ সেবক, আ’লীগ নেতাসহ সাধারন বাসিন্দারা। মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পাওয়া জেগে ওঠা চরের সকল বয়সের বাসিন্দারা জীবন দিয়ে হলেও ভূমিদস্যুদের কবল থেকে চর রক্ষার জন্য লাঠিসোঠা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে পাহারা অব্যাহত রেখেছেন।

ওই চরের বাসিন্দা আলামদ্দিন মাতুব্বরের স্ত্রী বৃদ্ধা ছলেমোন বিবি আক্ষেপ করে বলেন, “মোর শোয়ামীর (স্বামীর) গোয়াল ভরা গরু আর মোড়া ভরা ধান সবই আছিলো, পাঁচটা মাইয়া ও একটা পোলা লইয়া মোরা সুখেই আছিলাম। আল্লায় মোগো কপালে হেই সুখ বেশিদিন রাখলোনা, সর্বনাশা নদী মোর স্বামীর ৮ একর জমি কাইরা নেছে। এই বুড়া বয়সে কোন রহম খাইয়া না খাইয়া বাইচ্চা আছি”। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন ছলেমোন বিবি (৭৮)। একথ শুধু ছলেমান বিবির একারই নয়, একইভাবে জানালেন, গৃহহারা নিলুফা বেগম (৪৭), শাহানুর বেগম (৬৬) সহ অনেকেই। তারা আরো জানান, গত ৫ বছর পূর্বে নিশ্চিহ্ন গ্রামে চর জেগে ওঠায়া তারা আবার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

সাবেক উত্তর গাছুয়া ও বর্তমানের ষোলঘর গ্রামের মৃত নাজেম আলী সরদারের পুত্র আমির হোসেন সরদার (৫৭) জানান, ভাঙ্গন কবলিত গ্রামে চর জেগে ওঠায় নিঃস্ব পরিবারগুলো বাঁচার স্বপ্ন দেখলেও তাতে বাঁধ সাধেন চরকালেখা গ্রামের কতিপয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। তারা চর দখলের জন্য নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে একাধিকবার চরাঞ্চলবাসীর ওপর হামলা চালিয়েও ব্যর্থ হয়।

পরবর্তীতে তারা ভুক্তভোগী চরের বাসিন্দা ও চরকালেখা ইউনিয়ন আ’লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নুরুল হক খান, সমাজ সেবক আমির হোসেন সরদার, প্রধান শিক্ষক মোশারফ হোসেন সরদার, শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন খান, দিন ইসলাম সরদার, নুরুউদ্দিন সরদার গংকে আসামি করে ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থানায় মিথ্যে মামলা দায়ের করে হয়রানী শুরু করেন। স্থানীয় শাহে আলম দপ্তরি (৮০), সামচুল হক বেপারী (৭২) সহ গোটা চরাঞ্চলবাসী ভূমিদস্যুদের কবল থেকে জেগে ওঠা চর রক্ষা করে ভাঙ্গণ কবলিতদের কল্যানে বন্টন করে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ ব্যাপারে বরিশাল ৩ আসনের (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) সংসদ সদস্য ও বরিশাল জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারন সম্পাদক এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ টিপু সুলতান বলেন, উত্তর গাছুয়া গ্রামটি অনেক আগেই নদীতে গ্রাস করে নিয়েছে। বর্তমানে ওই নিশ্চিহ্ন গ্রামে জেগে ওঠা চর সহস্রাধীক গৃহহীন গ্রামবাসীর জন্য আর্শীবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভূমিদস্যুরা ফের অবৈধভাবে চর দখল করতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল সদর উপজেলাসহ মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদী ও গৌরনদী উপজেলায় জেগে ওঠা চরের জমি স্ব-স্ব এলাকার সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন পূর্বেই দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। চরের এসব জমি দখল নিয়ে হামলা, মামলা ও অসংখ্য প্রাণহানীর ঘটনাও রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই