গাজা যুদ্ধের ডায়েরি: ইসরাইলি বাহিনীর নারকীয় কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য (পর্ব ০৪)

পশ্চিমা মিডিয়ায় গাজাতে ইসরাইলি হামলার ঘটনা কি আসলেই সঠিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে? এই প্রশ্নে অনেকেই দ্বিধাবিভক্ত। ইসরাইলের নারকীয় হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবিক বির্পযয়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে অনেক স্থানীয় ফিলিস্তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন প্রকৃত অবস্থা। তেমনই একজন ফিলিস্তিন নারী ‘রাশা এন আবুশাবান’, তিনি ফিলিস্তিনে একটি আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি আর স্থানীয় অদেখা বিষয় নিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখে চলেছেন।

অষ্ট্রেলিয়ান গবেষণা এবং ডায়ালগভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আলোচনা.কম-এর তথ্য সহায়তায় প্রিয়.কম-এর পাঠকদের জন্য ‘রাশা এন আবুশাবান’-এর ডায়েরি অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল সাফি।
১২ জুলাই ২০১৪

যুদ্ধের চর্তুথ দিন। সত্যি বলছি, আমার আর লিখতে ইচ্ছা করছে না এবং দিন গুনতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। আমি মনে প্রাণে চাইছি ইসরাইলের এই আগ্রাসন বন্ধ হোক। গতরাতের ইসরাইলি নৌবাহিনীর ক্রমাগত হামলা ছিল ভয়াবহ। আমাদের বাড়ি সাগরের খুব কাছে, সেজন্য হামলার তীব্রতা বেশ ভালই টের পাচ্ছিলাম। গাজার সমুদ্র বন্দরে থাকা ‘গাজা আর্ক’ এর নৌযানটিও ধ্বংস হয়েছে হামলায়। ‘গাজা আর্ক’ ফিলিস্তিনিদের একটি প্রকল্প, ফিলিস্তিনের নৌযান এবং জেলে সম্প্রদায়কে নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ওই প্রকল্প। সমুদ্র বন্দরের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলছে, অনেক জেলের নৌযান ধ্বংস হয়ে গেছে।

‘গাজা আর্ক’ এর নৌযানটিও ধ্বংস হয়েছে হামলায়

এখন তাদের নৌকায় আগুন জ্বলছে আর হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ গাজার জেলেদের সমুদ্র তীর হতে মাত্র ৩ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে থাকার নির্দেশ জারি করেছে। ওই নির্দেশের ফলে ফিলিস্তিনি জেলেদের আয়ের উৎস সংকটের মুখে পড়েছে। ইসরাইলের আগের জারি করা ৬ নটিক্যাল মাইলের সীমাবদ্ধতার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন নিয়মের ফলে জেলেদের জীবন বিপর্যস্ত। এছাড়া সমুদ্রে ফিলিস্তিন নৌকায় বিনা কারণে গুলি, মারধর এবং লুটপাটের ঘটনা তো রয়েছেই।

যাই হোক ইসরাইলি বাহিনীর স্থল আক্রমণ এখনও শুরু হয়নি। হামাসের সেনা ইউনিট আল-কাসেম ব্রিগেড স্থল আক্রমনের হুমকি দিয়েছে। তারা প্রস্তুতি নিয়েছে এবং তাদের শক্তিমত্তার নির্দশন দেখিয়েছে। আমি জানি না আমার কি আল-কাসেম ব্রিগেডের এই পদক্ষেপের জন্য গর্ব করা উচিত কিনা? যদিও আমি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত না। সে যাই হোক, হামাস কিন্তু কখনই ইসরাইলের অন্যায় আচরণে চুপ থাকেনি। যুগ যুগ ধরে তারা এই প্রতিবাদ-পদক্ষেপ দেখিয়ে আসছে।

হামাসের রকেট ইসরাইলের মধ্যে ঢুকতে শুরু করেছে এবং ক্ষতিও করছে। যদিও আমি ইসরাইলের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান দিতে দেখেনি। আমি ইসরাইলি মিডিয়ার কয়েকজন এনালিস্টের কাছ থেকে শুনেছি যে জেরুজালেমের সিটি কর্পোরেশন ওইসব রকেটকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সিটির নাগরিকদের সাইরেন শুনলে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজেদের রক্ষার পরামর্শ দিয়েছে। হ্যা, এটা ঠিক ফিলিস্তিনি ৮/১০ টা রকেট ইসরাইলে আঘাত করছে এবং কিছু ক্ষতি করছে। কিন্তু ওইসব রকেট কি ইসরাইলের বাড়িঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে? তাতে কি ইসরাইলের সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে? উত্তর দিতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়, উত্তর ‘অবশ্যই না’। কিন্তু তার বিপরীতে ইসরাইলে গাজা উপত্যকায় কী রকম ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তা সবার জানা।

ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যে সংবাদটি চোখে পড়লো তা রাফা’তে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে। একদম ভোর বেলা ইসরাইলি এফ-১৬ বিমান স্থানীয় গান্নান পরিবারের ৩ তলা একটি ভবনে কোনো ধরণের সর্তকবার্তা ছাড়াই মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। গান্নান পরিবারের ৫ ঘুমন্ত সদস্য নিহত হয়েছে এবং ১৫ জন গুরুতর আহত হয়েছে।

গান্নান পরিবারের ৩ তলা একটি ভবনে কোনো ধরণের সর্তকবার্তা ছাড়াই মিসাইল নিক্ষেপ করেছে

ইসরাইলি বাহিনী এখন সরাসরি সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর কোনো ধরণের সর্তকবার্তা ছাড়াই হামলা শুরু করেছে। কি ভয়াবহ এবং অমানবিক ব্যাপার! একটু পরে আরেকটি সংবাদে মনটা খারাপ হয়ে গেল, স্থানীয় একটি অ্যাপার্টমেন্টে ইসরাইলি মিসাইল হামলায় আনাস আবু আল কাস নামে একজন তরুন ডাক্তার নিহত হয়েছে। আনাস তার বাবা-মাকে সেই ২০০৮-২০০৯ সালের ইসরাইলি হামলায় হারিয়েছিল। ইসরাইলের একের পর এক হামলার এক জেনরেশন হতে আরেক জেনারেশনের ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে। বিষয়টা যেন এমন, ‘তুমি এইবার সুযোগ পাওনি তো কী হয়েছে? এর পরের বার পাবে।’

সারাদিন আক্রমনের তীব্রতা একটু কম থাকলেও সন্ধ্যার পর হতে তা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আমি যে এলাকায় বাস করি সেখানে তুলনামূলক কম হামলা হচ্ছে, কিন্তু দূরের হামলার শব্দ সব সময়ই কানে আসছে। এই কিছুক্ষণ আগেই একটি খবরে দেখলাম, গাজা উপত্যাকার উত্তর-দক্ষিণ এবং মাঝামাঝি ঘনবসতি এলাকায় ইসরাইলি হামলা বেড়েছে।

আরেকটি সংবাদ দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে চলা টেনশন কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আলোচনা প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও ইসরাইল-হামাস দ্বন্দ্ব মেটাতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ওই অঞ্চল এখন ছুরির ডগায় রয়েছে। সংবাদ দুটো মনের মধ্যে একটু আশা সঞ্চার করলেও কয়েক ঘন্টা পরেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীূ নেতানিয়াহু প্রেস কনফারেন্সে বললেন, ‘ইসরাইলের উপর কোনো ধরণের চাপ হামাসকে দমন অভিযান বন্ধ করতে পারবে না।’ ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিবারম্যানও প্রধানমন্ত্রীর সুরে তাল মিলিয়ে বললো, ‘এখনই সময় গাজার উপরে সর্বশক্তি নিয়োগের, আমাদের ৮ম আয়রন ডোম তৈরি আছে।’

সারাটা দিন চাপের মধ্যে থাকার সহ্যশক্তি নষ্ট হতে চলেছে। তারপরেও কিছু করার নেই, বাসার বাচ্চাগুলোর কথা মাথায় রেখে আমরা স্বাভাবিক জীবনের ন্যায় একসাথে বসছি, কথা বলছি এবং যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করছি। আমি তো আমার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে একটি খেলায় মেতে উঠেছি- একটি মিসাইল/বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর পরই তাকে জিজ্ঞেস করছি এটা বিমান থেকে ছোড়া নাকি নৌবাহিনীর ছোড়া? সে খুবই স্মার্টনেস দেখাচ্ছে উত্তর দিতে, কারণ সে ইতোমধ্যে ওই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত। ১৪ বছর বয়সের আমার ভ্রাতুষ্পুত্রটি ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৪ সালের গাজা উপত্যাকায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ দেখেছে, কাজেই তার কাছে এটা অনেকটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সে ইতোমধ্যে আমাকে এও জানিয়েছে যে, সে অনেক কিছু জানে যা সে তার বয়সকালে তার নাতি-নাতিনীদের কাছে বলবে। সে আরেকটি প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই করে, ‘আমরা কবে আমাদের ভূমি ফিরে পাব?’ কারণ সে প্রতি শুক্রবার আল-আকসা মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজের পর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবে। গাজার প্রতিটি শিশুই ওই আশা নিয়ে বড় হচ্ছে, তারা মনে করছে একদিন ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে এবং আমরা আমদের ভূমি ফিরে পাবো।

অবশেষে ফিলিস্তিনের তথাকথিত প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম তার মুখ খুললেন। সে বলেছে, সংঘর্ষ এড়াতে তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই লোক কি আমাদের ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধি? তার কি কোনো দায়িত্ব আছে মৃত্যুর মুখে থাকা ফিলিস্তিনি জনগনের ওপর? সে এখন পর্যন্ত কী করেছে? সে কি ইসরাইলিদের প্রতি শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পেরেছে, যা প্রায় এক যুগ ধরে বন্ধ?

দিনের সবচেয়ে হাস্যকর সংবাদ হচ্ছে, ফিলিস্তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার ছাত্রছাত্রীদের এবছরের নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছে। ওহ আল্লাহ! এরা কোন গ্রহে বাস করে? এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এমন কী হলো যে, তাদের এখন এই ফলাফল প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়লো? ছি! যদিও স্থানীয় ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিবাদের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই ঘোষণা থেকে সরে আসে।

আজকের দিনে আমি একটি হ্নদয়বিদারক ভিডিও দেখেছি, ওই ভিডিওতে এক ফিলিস্তিনি বাবা তার ছোট্ট সন্তানের মস্তক বিচ্ছিন্ন শরীর বুকে জড়িয়ে আহাজারি করছে। সে ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে এবং তার বুক থেকে সন্তানের দেহ ছাড়তে চা্ইছে না। আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম এবং চিন্তা করলাম, এ রকমতো অনেক হ্নদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে যা আমি বলতে পারি। মুর্হুতেই বোবা হয়ে গেলাম। আমার মনে হতে থাকলো, হয়তো সারা বিশ্বের সব মসজিদ-গীর্জার প্রার্থনার বাণীর চেয়ে গাজার বিভিন্ন হাসপাতালের দেওয়াল অনেক কান্না এবং প্রার্থনার সাক্ষী হয়ে আছে।

ইসরাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ি

ফিলিস্তিনের গৃহায়ন এবং গণর্পূত মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ শুনে আমার দিন শেষ হলো। মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সূত্রমতে, ২৮২ বাড়িঘর একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে, ২৬০ বাড়ি মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বসবাস অযোগ্য হয়েছে এবং ৮,৯১০ বাড়ি কোনো না কোনো ভাবে ইসরাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেইসাথে গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের খবর, ১০৫ জন নিহত এবং ৭৮৫ জন আহত।

ক্লান্ত শরীর বিছানার দিকে টানছে আমাকে। এই মুর্হুতে আমার এলাকা গত কয়েকদিনের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, দূরে কিছু বিস্ফোরণের শব্দ আসছে। তবে ইসরাইলি ড্রোনের অনবরত টহল আর সাপের ন্যায় সেগুলোর শব্দ এখনও পাচ্ছি। আমার মনের মধ্যে অনেক কিছুই সবসময় ঘুরপাক খায়, তবে এই মুর্হুতে আমার শুধু এটাই মনে হচ্ছে, ‘যেন আমি আমার কোনো প্রিয়জনকে না হারাই’। আমি তা সহ্য করতে পারবো না, এমনকি আমি নিজেও মরতে চাই না। আমার জীবন কেবল শুরু, আমি অনেক ভ্রমণ করতে চাই, পৃথিবী ভ্রমণ করতে চাই, আমার কর্মজীবনের পরিধি বাড়াতে চাই এবং একটি পরিবারের স্বপ্ন দেখি। খুবই সাধারণ চাওয়া, তাই না? এমন স্বপ্নই হয়তো দেখছিল ওইসব ফিলিস্তিনি যারা কিছুসময় আগে ইসরাইলি হামলায় মারা গেছে।



মন্তব্য চালু নেই