ক্ষোভে ভারতের বয়স্ক ভাতা নিচ্ছেন না আজগর আলী
একবছর পেরিয়েছে ছিট ভাগাভাগির। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস নিয়ে ভাগ হয়েছিল দু’দেশের ছিটমহল। ভারত থেকে পাওয়া ছিটে বাংলাদেশের অংশে ইতোমধ্যে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ, গড়েছে স্কুল, লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিট ভাগের কদিন পরেই ঘুরে এসেছেন এসব এলাকা। আর বছর ফিরে তাই নানা উৎসবে পার করছে নতুন বাংলাদেশের বাসিন্দারা।
এর ঠিক বিপরীত চিত্রই বাংলাদেশ থেকে পাওয়া ভারতীয় ছিটে। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেল এক বছরে এতটুকু বদলায়নি নতুন ভারতীয় অধিবাসীদের ভাগ্য। বরং ভারতভুক্তির যে উচ্ছ্বাস নিয়ে আনন্দে মেতেছিল বাসিন্দারা এক বছরে তা ক্রমেই মিইয়ে গেছে।
আজগর আলী নামের বৃদ্ধের ‘গল্প’ প্রকাশ হয়েছে পত্রিকাটিতে। মশালডাঙ্গা ছিটের ১০৩ বছর বয়সী আজগর আনন্দ উচ্ছ্বাসে যোগ নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন ভারতের। মুখে কালো কাপড় বেঁধে নেমেছেন আন্দোলনে। প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করেছেন ভারত সরকারের দেয়া বার্ধক্য ভাতা। তার মতে, এক বছরে ভারত সরকার একটা টাকাও ঢালেনি সাবেক এই বাংলাদেশি ছিটগুলোয়। আজো বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। আর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, আপাতত ভাতা দেয়া হবে ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের। তিনি বলেছেন, ‘আমার চেয়ে অসহায় অনেক মানুষ এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আমি তাই কিছুতেই টাকা নেব না।’
পোয়াতুর কুঠির ছিটের বৃদ্ধ মনসুর শেখের স্বাধীনতা দেখেছেন তিন তিনটা। প্রথমে হয়েছিলেন পাকিস্তানি, তার পরে বাংলাদেশি, এখন ‘ইন্ডিয়ান’। এক বছরে তারো মুখের হাসি উধাও হয়েছে। ২০১৫-র ৩১ জুলাই ভারতীয় জাতীয় পতাকার রঙের টুপি পরে উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিলেন এই ছিটেরই বাসিন্দা বিষ্ণু বর্মন, মশালডাঙার জামাল শেখরা। আজ ঠিক একটা বছর পরে রোববার (৩১ জুলাই) তারা মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদী মিছিলে।
বন্যায় বত্রিগাছ আর ভুরুঙ্গামারি ছিট ডুবে চাষবাস ভেসে গেছে। কেউ কোনো ত্রাণ, ক্ষতিপূরণ পাননি, পাবেনও না। কেন? ভারতীয় হওয়ার বর্ষপূর্তি হলেও ছিটবাসীদের জমির মালিকানার দলিল এখনো বাংলাদেশি। প্রশাসন থেকে ব্যাংক- কেউই সেই কাগজ নেয় না। কাজেই মালিকানা প্রমাণের উপায় নেই। সেই কাগজ বদলে নতুন দলিল দেয়ার কোনো সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়নি এক বছরেও।
ছিটের বাসিন্দাদের প্রায় সকলের জীবিকা চাষাবাদ। বর্ষা শুরু আগে তাদের অনেকেই কৃষিঋণের খোঁজে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফিরেছেন। বাংলাদেশি দলিল দেখে হাসাহাসি করেছেন সরকারি কর্মীরা। জানিয়ে দিয়েছেন তারা— এটা ভারত, এখানে ও কাগজ চলে না। বানে-খরায় চাষ নষ্ট হলে সরকার ‘ফসল বিমা’ দেয়। সে বিমার সুযোগ নেয়ারও উপায় নেই। কারণ সেই একই— বাংলাদেশি জমির দলিল গ্রাহ্য নয়।
টিনের বাসায় থাকেন সাবেক ছিটের অধিকাংশ বাসিন্দা। সরকারি ভর্তুকিতে ইটের বাড়ি পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দিনহাটায় গিয়ে ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’র আবেদন করেছিলেন নতুন ভারতীয় হওয়া বেশ কয়েকজন। এসডিও অফিস তাদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, বসত জমির ভারতীয় দলিল না পেলে ঘরও উঠবে না।
ভারতীয় যে ১১০টি ছিটমহল বাংলাদেশে মিশেছে, সেখানে যে দলিল পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে, সে খবর কিন্তু এসেছে মশালডাঙ্গা, বত্রিগাছ বা ভুরুঙ্গামারিতে। তার পরে কোচবিহারে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন জয়নাল, সাদ্দাম, আলমগীরের মতো সাবেক ছিটের বাসিন্দারা। এ পারে তা কবে শুরু হবে, কিছুই বলতে পারেননি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। অথচ শুধু এই জমির ‘ইন্ডিয়ান’ দলিলের জন্যই থমকে আছে সব কিছু। রাস্তা তৈরি হচ্ছে না। স্কুল বা আইসিডিএস-এর জমি বাছা যাচ্ছে না। এমনকী জব কার্ড বিলির পরেও শুরু করা যায়নি ‘১০০ দিনের কাজ’। সেই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে জব্বার শেখ বলছেন— এটা ধুয়ে জল খেয়েই আমরা পেট ভরাবো!
এক বছরে সরকারি কাজ বলতে তিনটে কার্ড পেয়েছেন সাবেক ছিটবাসীরা। জব কার্ড, আধার কার্ড আর ভোটার কার্ড। কিন্তু জমির দলিল পরিবর্তন নিয়ে প্রশাসন নীরব। আর সেই মওকায় জমি-হাঙরদের চোখ পড়েছে সাবেক ছিটে। হানাহানির আশঙ্কা বাড়ছে। আর বৃদ্ধ মনসুর-আজগর থেকে নতুন প্রজন্মের বিষ্ণু, সাদ্দাম, জামালরা ভাবছেন- এ কেমন স্বাধীনতা, যার জন্য ৬৯ বছর হাপিত্যেশ করেছিলেন ছিটের মানুষ!
মন্তব্য চালু নেই