কোরবানির গরু-মহিষের কারবার নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড

পবিত্র কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত সীমান্তের ৩১টি করিডোর দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার গরু-মহিষ বৈধভাবে আসছে। সেই সাথে বেড়েছে পশু চোরাচালান। এছাড়া ওইসব গরু-মহিষ বিক্রির জন্য যেসব হাট বসতে যাচ্ছে তা ইজারা নিয়েও চলছে নানা অনিয়ম।

চোরাচালান হয়ে আসা গরু ও মহিষের দাম মেটাতে টাকার বদলে স্বর্ণের বিস্কুটের ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএসএফের কড়াকড়ি ও বিজিবির সতর্কাবস্থানের কারণে এবার সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ভারতীয় গরু কম আসছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে হাট ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় নেতাদের নানা অনিয়ম প্রকাশ পাচ্ছে।

গরু মহিষ চোরাচালান চিত্র

ভারতের বিভিন্ন হাট থেকে সস্তায় কেনা গরু ভারতীয় মহাজন বা গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্তসংলগ্ন গ্রামের বিভিন্ন অংশে জড়ো করে বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ী বা মহাজনকে খবর দেন। সাধারণত বাংলাদেশের মহাজনরা লোক পাঠিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ওপার থেকে গরু নিয়ে আসেন। সীমান্তের বেশিরভাগ স্থান কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। রাখালরা প্রথমে বেড়া কেটে ফেলেন। পরে সেখান থেকে ছোট গরুর হাত-পা বেঁধে বস্তায় ভরে কাঁটাতারের বেড়া বা গেটের ওপর দিয়ে পার করে দেন। পাহাড়ি এলাকায় ওপর থেকে গড়িয়ে দেওয়া হয় গরু।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে গবাদিপশু বাংলাদেশে প্রবেশ করায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যবস্থা নিতে সাতক্ষীরা, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কাকডাঙ্গা বিওপি, চান্দুড়িয়া বিওপি, সদর উপজেলার ঘোনা বিওপি, ভোমরা বিওপি, বৈকারী বিওপি, বৈকারী বিওপি সনি্নকটে, কুশখালী বিওপি, দেবহাটার কোমরপুর বিওপি, ভাতশালা বিওপি, যশোরের শার্শা উপজেলার অগ্রভুলট বিওপি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর বিওপি, মাসুদপুর ও নওগাঁর সাপাহার উপজেলার খঞ্জনপুরের বিট বা খাটাল বন্ধ করতেও সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওইসব এলাকা দিয়েই বেশি গরু-মহিষ অবৈধ পথে দেশে প্রবেশ করছে।

দাম মেটাতে ব্যবহার হচ্ছে স্বর্ণের বিস্কুট

গত শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ, ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের (ডিআরআই) কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, পাচার করা গরুর দাম আগে হুন্ডিতে পরিশোধ হলেও এখন স্বর্ণের বিস্কুটে মেটানো হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা নিয়ে ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতেই স্বর্ণের বারের মাধ্যমে লেনদেন সহজ মনে করা হচ্ছে। গত দেড় মাসে সীমান্তরক্ষীদের হাতে প্রায় ১৫টি ঘটনা ধরা পড়েছে। শুধু উত্তর চবি্বশ পরগনার বসিরহাট, স্বরূপনগর সীমান্তে প্রায় ২৫ কোটি টাকার স্বর্ণ এবং বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্তে ১৭ কোটি টাকার মতো স্বর্ণ বাজেয়াপ্ত করেছে ভারতীয় শুল্ক দপ্তর ও বিএসএফ।

এসডিপিও (বসিরহাট) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে বলেন, ধরা পড়া পাচারকারীদের জেরা করে জানা গেছে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরুর দাম সোনায় পরিশোধ করায় স্বর্ণ পাচার বেড়ে গেছে।

রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

এনবিআরের হিসাবে, গত অর্থবছরে গরু থেকে ৯৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এর আগের বছর পশু আমদানি করা হয় ১৪ লাখ ৪০ হাজার। এ থেকে ৭৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সীমান্তের ব্যবসায়ীরা জানান, গরু ব্যবসার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন বিট বা খাটাল মালিকরা। এদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিটের অনুমোদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

সীমান্তবর্তী গরুর খাটালে চলছে চাঁদাবাজি। গরুপ্রতি প্রায় দেড় হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ গরুপ্রতি সরকার রাজস্ব পাচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা।

সীমান্তের ওপার থেকে আসা গরু খোঁয়াড়ের মতো দেখতে একটি স্থানে জড়ো করা হয়। স্থানীয়ভাবে একে খাটাল বা বিট বলা হয়। এর পর শুল্ক কর্মকর্তারা প্রথা অনুসারে খাটালের গরুগুলো প্রথমে মালিকানাবিহীন অবস্থায় দেখিয়ে ‘বাজেয়াপ্ত’ ঘোষণা করেন। বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাগজে-কলমে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালতও বসে। আদালতের রায়ে ‘মালিকবিহীন বাজেয়াপ্ত’ গরু মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

বাস্তবে গরু চোরাকারবারির কাছেই থাকে। চোরাকারবারির কাছ থেকেই গরু ব্যবসায়ী নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে গরু কেনেন। সরকারকে ৫০০ টাকা দেওয়ার বিনিময়ে চার দিন মেয়াদি গরুর মালিকানার রসিদ পান ব্যবসায়ীরা। রসিদের নম্বরটি গরুর গায়ে রঙ দিয়ে লিখে দেওয়া হয়।

গরু-মহিষের জন্য প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ

চলতি বছরের গত আট মাসেই সীমান্তে গুলিবর্ষণের ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত ও ৬২ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ২৮৪ বাংলাদেশি ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছেন। তাদের ২০৫ জনকে গ্রেফতারের পর ওই দেশের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিজিবির একটি সূত্র বলছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যেসব গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, তার ৯০ শতাংশের পেছনেই থাকে গরু-বাণিজ্য।

বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে গরুর ব্যবসাকে বৈধতা দেওয়া নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে ভারতের পক্ষে গরু রফতানির অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়।

হাট ইজারায় অনিয়ম

সীমান্তের ওপার থেকে গরু-মহিষ দেশের বিভিন্ন জেলাতে ছড়িয়ে পরার পরে বিভিন্ন হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে ব্যবসায়ীরা। সাধারণ সময়ে একটি গৎবাঁধা নিয়মে চলে বিক্রি। তবে ঈদকে সামনে রেখে হাট ব্যবস্থাপনা এবং হাটের ইজারা নিয়ে চলছে নানা অব্যবস্থা আর অনিয়ম, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে নানা প্রতিবেদন।

সারাদেশে নানা ছোট-বড় অনিয়মের ঘটনা থাকলেও রাজধানীতেই সবচেয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এবার ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে পশুর ১৮টি হাট বসবে। এবার ১৮টি হাটের মধ্যে ডিএসসিসির আওতায় থাকবে ১১টি। উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বসবে সাতটি। এ পর্যন্ত ১৪টি হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ইজারা পেয়েছে সরকারদলীয় লোকজন।

অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশন ও সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার যোগসাজশে একটি সিন্ডিকেট রাজধানীর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করছে। বেশি লাভের আশায় তারা সমঝোতার ভিত্তিতে শিডিউলে কম দর প্রস্তাব করেছে।

বারবার দরপত্র আহবান করেও সঠিক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। যোগসাজশে বারবার কম দাম প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিএসসিসির দরপত্র বাতিল হওয়া হাটগুলো হলো জিগাতলা হাজারীবাগ মাঠ, লালবাগে মরহুম হাজি দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ ও বেড়িবাঁধসংলগ্ন খালি জায়গা, গোলাপবাগ মাঠের পাশে সিটি করপোরেশনের আদর্শ স্কুল মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গা, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন জায়গা। ডিএনসিসিতে বাতিল করা হয়েছে বনরূপা হাউজিংয়ের মাঠের দরপত্র।

গত ১১ ও ১২ আগস্ট প্রথম দফায় দুই সিটি করপোরেশনের পশুর হাটের ইজারার দরপত্রের বাক্স খোলা হয়। উত্তরের আট হাটের জন্য ৬০টি শিডিউল বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু বাক্স খুলে দেখা যায় জমা পড়েছে মাত্র ২৪টি।

হাজারীবাগ মাঠের জন্য ১৯টি দরপত্র বিক্রি হয়েছিল। প্রথম দফায় শিডিউল জমা পড়েছিল মাত্র একটি। তাতে দর প্রস্তাব করা হয়েছিল ১১ লাখ ১১ হাজার ১০ টাকা। গত বছর এ হাটের দর উঠেছিল ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার ২০ টাকা। লালবাগ হাজি দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ ও বেড়িবাঁধসংলগ্ন খালি জায়গা ইজারা নিতে তিনটি শিডিউল জমা পড়েছিল। সর্বোচ্চ দর প্রস্তাব করা হয়েছিল এক কোটি এক লাখ এক হাজার ১০০ টাকা। গত বছর এ হাটের সর্বোচ্চ দর ছিল চার কোটি এক লাখ ১১ হাজার ৫০৭ টাকা। কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন জায়গাটি ইজারা নেওয়ার জন্যও তিনটি শিডিউল জমা পড়েছিল। উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারসংলগ্ন মৈত্রী সংঘের মাঠটি ইজারার জন্যও মাত্র তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। দ্বিতীয় দফায় কেবল মৈত্রী সংঘের মাঠ ইজারা দেওয়া হয়েছে। সন্তোষজনক দর না পাওয়ায় ফের পাঁচ হাটের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়।

প্রশাসনের অবস্থান

পশুর হাট নিয়ে নাগরিক ভোগান্তি এড়াতে এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সব ধরনের নিময়নীতি মেনে চলতে ইতিমধ্যে রাজধানীর সব ইজারাদারকে নিয়ে বৈঠক করেছে ডিএমপি কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে হাসিল জনসম্মুখে টাঙিয়ে দেওয়া, হাটে ক্যান্টিন বাধ্যতামূলক করা, জোর করে অন্য হাটের গরু না নামানো, জাল নোট চিহ্নিতকরণ এবং হাটের চার থেকে পাঁচ দিন আগে গরু ঢাকায় না আনাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত না মানলে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

এ ছাড়া আন্তমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে বাবুবাজার, নয়াবাজার, আর্মানিটোলা, আগারগাঁও ও বনানী হাট অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পবিত্র কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই গরু-মহিষ আমদানি এবং হাট নিয়ে এরকম নানা সমস্যা-প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপে অনিয়ম অনেকখানি কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।



মন্তব্য চালু নেই