জামায়াতের সহিংসতা ও অর্থের উৎস

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস এবং সহিংসতা করেছে জামায়াত তার অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শুরু থেকেই। হাজার হাজার ককটেল বিস্ফোরণ, গানপাউডার, অস্ত্রশস্ত্র কেনা, কর্মীদের পেছনে খরচ করা কাড়ি কাড়ি টাকা জামায়াত কোথায় পেল সে প্রশ্নের একটি জবাব বুঝি এবার পাওয়া গেল। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ফাঁস করে দিয়েছে জামায়াতকে সারদা গ্রুপের অর্থ সহায়তার কথা।

ধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে জামায়াতের অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ পুরনো। জামায়াত কখনই এই অর্থের উৎসের কথা স্বীকার না করলেও মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির নামে গোলাম আযমের চাঁদার রসিদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। জামায়াতের ব্যাংক, বীমা, এনজিও, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ব্যবসা, আবাসন প্রকল্প বিদেশি টাকাতেই গড়ে উঠছে বলেও অভিযোগ আছে। দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসেও এসব প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যবহার হয় বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত অর্থ লেনদেনে ইসলামী ব্যাংক-কে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার জরিমানাও করেছে। এই জঙ্গি অর্থায়ন রুখতে কাজ শুরু করেছে সরকারের একটি বিশেষ সেল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, বেশ কিছু ব্যাংকের ওপর নজরদারি শুরু করেছেন তারা।

আনন্দবাজারের খবর অনুযায়ী, জামায়াতকে অর্থ সহায়তার সঙ্গে জড়িত আছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল মমতা ব্যানার্জি। জামায়াতকে সুবিধা করে দিতেই স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিরোধিতা করেছেন মমতা। জামায়াতের ভারতবিরোধী প্রকাশ্য অবস্থান আর তলে তলে দেশটির রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এই দহরম মহরমের খবর প্রকাশের পর কেবল জামায়াত নয়, বিপাকে আছেন দৌর্দ- প্রতাপে শাসন চালানো মমতা ব্যানার্জিও।

জামায়াতকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করছেন সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা। জামায়াত আন্দোলনের নামে যেসব এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়েছে তার প্রায় প্রতিটিই পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের জনপদ। এই খবর প্রকাশের পর সীমান্ত এলাকায় বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক ও জামায়াতপন্থি হিসেবে পরিচিত এনজিওর ওপর নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে হরতালে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলা লালমনিরহাট ও জয়পুরহাটে সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৬ জন।

এর আগে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দ- দেওয়ার পরও জামায়াত যেসব এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়েছে সেগুলোও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকার জনপদ। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় প্রতিদিন জামায়াতের নৃশংসতা হয়েছে। এছাড়া বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের যেসব এলাকায় ত্রাস ছড়িয়েছে জামায়াত  সেগুলোও পশ্চিম সীমান্ত থেকে দূরে নয় খুব একটা।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা মনে করেন, সারদা কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে ঢুকছে এবং তা জামায়াত পেয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সীমান্ত এলাকা থেকে জামায়াতকে বিভিন্ন ধরনের সহিংস উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছিল। আগেই আমাদের সন্দেহ হয়েছিল, এখন বিষয়গুলো পরিষ্কার হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এভাবে একটি দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশের কোনো দলের ষড়যন্ত্র ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তদন্ত হলে আরও গোপন তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

জামায়াতের সহিংসতার সাক্ষী সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য মুস্তাফা লুৎফুল্লাহরও দাবি একই। জামায়াত নিজেদের রক্ষায় ওপারের একটি শক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন,  ‘আমাদের হাতে সুনির্দিষ্ট খবর আছে, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নেতারা জামায়াতের দুষ্কৃতকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বন্দোবস্ত করছে। নিয়মিত টাকাও দিয়েছে। এগুলো আগেই স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমরা জানিয়েছি।’

লুৎফুল্লাহ জানান, ‘গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের সহিংসতার সময় আফগান জিয়া ও তার বাহিনী এপারে হত্যা করে ভারতে ঢুকে পড়ত। তারা কেউ পুলিশের গুলিতে আহত হলে চিকিৎসা নিত তৃণমূলের আশ্রয়ে। মূলত গরুসহ অন্যান্য জিনিস আদান-প্রদানের পেছনে ছিল জামায়াতের টাকা লেনদেনের ঘটনা।’

২৮ এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি সহিংসতায় সাতক্ষীরায় ৯ জন, রংপুরের মিঠাপুকুরে ৬ জন, গাইবান্ধায় ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৭ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক প্রকৌশলীসহ দুইজন, সিরাজগঞ্জে দুইজন, বগুড়া, দিনাজপুর, নাটোর, মৌলভীবাজারে একজন করে ৪ জন, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুইজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, কক্সবাজারে দুইজন প্রাণ হারান। এর বাইরে রাজধানীতেও দুইজন প্রাণ হারান।

কেন উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাকে সহিংসতার অভয়ারণ্য বানিয়েছিল জামায়াত? দেরিতে হলেও এই প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সবার কাছে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে বিতর্কিত অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সারদা গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারির কথা। যেখানে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর নাম। জামায়াতকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সহিংস পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি অংশ। আর জামায়াতও লুফে নিয়েছিল সেই মওকা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামীর জন্ম হয়েছিল হিন্দুস্থানে। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এখনও আছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জামায়াতে ইসলামী শত্রুপক্ষের হয়ে এদেশের মানুষের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে। যে কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এদেশে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নাম পাল্টে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামে এদেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী দলটি। এত বছর পর এসে ভারতের সারদা গ্রুপ থেকে টাকা নিয়ে দেশে সহিংসতার আগুন জ্বালিয়ে জামায়াত প্রমাণ করে দিল যে, নামে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও আদতে এখনও জামায়াতে ইসলামী হিন্দকেই মনেপ্রাণে ধারণ করছে।

সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে বিপাকে আছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। দলটির সংসদ সদস্য আহমেদ হাসান ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গোপন আঁতাত ছিল। তার মাধ্যমেই সারদা বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে টাকা পাচার করেছে। এসব অর্থের বড় একটি অংশ জামায়াতকে দিয়েছে সহিংসতার রসদ হিসেবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যতটাই ভালো, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দূরত্ব যেন ততটাই বেশি। তিস্তা চুক্তি, স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে বরাবরই বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ সরকারপ্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মূলত তার বিরোধিতার কারণেই কেন্দ্রে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের অমীমাংসিত এসব বিষয়ের কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। এর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আলাদা সফরে এসব বিষয়ে মীমাংসা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতার বিরোধিতার কারণেই পালে হাওয়া পায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এসব কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মমতার সম্পর্কের একটা অলিখিত দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বহু আগে। তৃণমূল কংগ্রেস তাই বাংলাদেশের ক্ষমতা পালাবদলের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এমন দলকে ক্ষমতায় আনতেই জামায়াতকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সহিংসতা উস্কে দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।

সারদার কোটি কোটি টাকা জামায়াতের পেছনে ঢালার বিষয়টি এড়িয়ে যায়নি গোয়েন্দাদের চোখ। দেশের গোয়েন্দারা আগেই সরকারকে জানিয়েছে বিষয়টি। সে অনুযায়ী এ নিয়ে ভারত সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ। আর জামায়াতকে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে ভারতের সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ১২ সেপ্টেম্বর এ কথা জানিয়েছেন।

নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আগেভাগেই অস্বীকার করে বসে আছেন তৃণমূল সংসদ সদস্য হাসান ইমরান। তার সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি। এদিকে অভিযোগ ওঠার পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ-সম্পর্ক নেই। তাদের নেতা ইমরানের মাধ্যমে টাকা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

তবে গোয়েন্দারা বলছেন, ইমরান জামায়াতের অর্থায়নে পরিচালিত একটি পত্রিকার কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত। সে এই পরিচয়ে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছে।

তৃণমূলে অস্বস্তি, বাদানুবাদ

চিট ফান্ডের মাধ্যমে সারদার মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়াসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত বছর গ্রেপ্তার হন ব্যবসায়িক এই গোষ্ঠীর প্রধান সুদীপ্ত সেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। রাজনীতিবিদ ও চলচ্চিত্র তারকাসহ অনেকের নাম এসেছে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে। এরপর তৃণমূল সংসদ সদস্য আহমেদ হাসান ইমরানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ উঠেছে জামায়াতকে সহিংসতার জন্য টাকা যোগান দেওয়ার। এ নিয়ে দারুণ বেকায়দায় পড়েছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। দলটির ভেতরে-বাইরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয়েছে নিজেদের মধ্যেই। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করার খবরটি প্রমাণিত হলে ভবিষ্যতে তৃণমূলকে বড় ধরনের ধকল পোহাতে হতে পারে এমন দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হতে বসেছে দলটির শীর্ষ নেতাদের।

হাসান ইমরানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বাদানুবাদেও জড়িয়েছে তৃণমূল ও কেন্দ্রের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। নিজ দলের সংসদ সদস্যকে রক্ষায় তৃণমূলের দাবি, হাসান ইমরান সংখ্যালঘু হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে তাকে মিথ্যা অভিযোগে জড়ানো হচ্ছে। দলটির প্রবীণ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, বিজেপি প্রাদেশিকতা ও সংঘর্ষ ছড়াতে চাইছে। তাই এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছে। আর বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ সিংয়ের সাফ কথা, ইমরান দেশদ্রোহে যুক্ত। এখানে এটাই কথা। তাকে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না।

জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি তৃণমূলের নেতারা

নিজ দলের নেতার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ ওঠার পর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন তৃণমূলের একাধিক নেতা ও সংসদ সদস্য। এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) ও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই এসব জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তৃণমূল অভিযোগ করছে, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছে।

বিজেপি সর্বভারতীয় নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং গত ১১ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেন, সারদা গোষ্ঠীর বেআইনিভাবে তোলা আমানত ইমরানের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর কাছে পৌঁছেছে। এর পরদিনই সিদ্ধার্থের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ দায়ের করেন ইমরান।

তবে ওই দিনই নয়াদিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে রাজনাথ সিং বলেন, ‘সিবিআই আইন মেনেই কাজ করছে। আইন আইনের পথেই চলবে। এতে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না।’

যেভাবে বেরিয়ে এল গোপন তথ্য

বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে সম্প্রতি ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। যেখানে বলা হয়, ২০১২-১৩ সালে তৃণমূলের সাংসদ ইমরানের মাধ্যমে সারদার অর্থের একটা বড় অংশ ভারত থেকে দফায় দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পৌঁছেছে জামায়াত ও তাদের নানা শাখা সংগঠনের হাতে।

‘জামায়াতের সন্ত্রাসেও সারদার টাকা’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারদার বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সে ভারতীয় রুপির বান্ডিল ভরে তা নিয়ে যাওয়া হতো বাংলাদেশের সাতক্ষীরা-রাজশাহী সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে। তার পর তা বাংলাদেশি টাকা, ডলার বা ইউরোয় পরিবর্তন করে জামায়াতের এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও গিয়েছে সারদার অর্থ।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জামায়াত পরিচালিত বেশ কিছু হাসপাতাল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেনামে অর্থের জোগান দিয়েছে সারদা। সেই অর্থও জামায়াত জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে ব্যবহার করেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগ থেকেই বাংলাদেশের জামায়াতের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু উর্দুভাষী নেতার দহরম মহরম শুরু হয়। ২০১১ সালের নির্বাচনে সীমান্ত এলাকায় জামায়াত কর্মীরা তৃণমূলের হয়ে কাজ করে। সে সময় তৃণমূলকে অর্থের জোগান দিয়েছিল জামায়াত।

এবার ডেকে নিয়ে আবিদার সঙ্গে কথা বললেন মমতা

দীর্ঘ দুই বছর একাধিকবার সময় চেয়েও দেখা করার সুযোগ পাননি বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। কলকাতা থেকে বিদায়ের আগে অন্তত একবার দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও অনুমতি মেলেনি মমতার কাছ থেকে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আর সারদার অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর যখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে খানিকটা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন মমতা, ঠিক সেই সময় আবিদা ইসলামকে ডেকে পাঠালেন বৈঠকের জন্য।

কূটনৈতিক ভাষায় একে আবিদার বিদায়ের আগে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হলেও জামায়াত ইস্যুতে মমতা তার অবস্থান তুলে ধরতে পারেন আবিদার কাছে। এছাড়া এই মুহূর্তে মমতার ব্যাখ্যা দেওয়ার অন্য কোনো পথ নেই বলে মনে করেন কূটনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত ও ছাত্রশিবির নারকীয় তা-ব চালিয়েছে, মানুষ খুন করেছে, বাসে আগুন দিয়ে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা মাকে পুড়িয়ে মেরেছে, ট্রাকে, ট্যাক্সি ও সিএনজি অটোরিকশায় পেট্রোল বোমা হামলা করেছে। বাসে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করেছে,  মন্দির ভেঙেছে, সম্পদ ধ্বংস করেছে। এর দায় এড়াতে পারেন না মমতা। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরিতে রাজ্যসভার সদস্য ইমরানকে দিয়ে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে যে অর্থ দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা তদন্ত করারও ঘোষণা দিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিষিদ্ধ ঘোষিত স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট (সিমি) নেতা ইমরানকে রাজ্যসভায় প্রার্থী করেন জামায়াতের লবির কারণেই। সারদা থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ এনে তা ইমরানের মাধ্যমেই বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়া হতো।

বিজেপির প্রভাবশালী নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিং অভিযোগ করেছেন, সিমির নেতা ইমরানকে রাজ্যসভায় সদস্য করে এবং ভারতবিরোধী একটি কট্টর মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অর্থ দিয়ে মমতা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, এটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। এর পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং মমতার এই সন্ত্রাস-দুর্নীতির তদন্ত করার ঘোষণা দেওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েন মমতা। এ কারণেই তিনি আবিদা ইসলামকে সাক্ষাৎ দেওয়ার জন্য সময় দিয়েছেন।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ে

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবেদন খারিজ করে দিয়ে চলতি বছরের ৯ মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সারদা কেলেঙ্কারি মামলাটির তদন্তের দায়ভার সিবিআইর কাছে হস্তান্তর করে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের মতে, এই কেলেঙ্কারিতে আন্তঃপ্রদেশ এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তাই সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য মামলাটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইর কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ প্রদান করে।

একই সঙ্গে আদালত মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে (ইডি) নির্দেশ প্রদান করেছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ও রিজার্ভ ব্যাংকের ভূমিকা খতিয়ে দেখার নির্দেশ প্রদান করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

উল্লেখ্য, সারদা গোষ্ঠী বিনিয়োগ তহবিল গঠনের নামে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় ৫০০০০ কোটি রুপি হাতিয়ে নেয়। কিন্তু লোকসানের কারণ দেখিয়ে গত বছর তহবিলটি ভেঙে দেয় সারদা। এরই প্রেক্ষিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিষয়টি তদন্তের জন্য রাজ্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়। পরবর্তী সময়ে সিবিআই জনস্বার্থে নিজেই মামলা তদন্তের এখতিয়ার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি পেশ করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে আর্জি খারিজের আবেদন পেশ করে।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তদন্তভার সিবিআইর হাতে যাওয়া ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল মমতা সরকার। কারণ তদন্ত সিআইডির হাতে থাকলে তা প্রভাবিত করার সুযোগ পেত তৃণমূল।

ইডির প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে

সিবিআই তদন্তের আগেই এই আর্থিক কেলেঙ্কারি তদন্তে নামে ভারতের ইডি। সেই তদন্তের অন্তর্বর্তীকালীন এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সারদার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে অন্তত ৮০০ কোটি রুপি চলে গেছে বিভিন্ন নেতার কাছে। তবে এ অর্থ ওই সব নেতার কাছে গেছে বেনামি ব্যাংক হিসাবে। ইডি সেসব বেনামি হিসাবের প্রকৃত মালিক কারা তা তদন্ত করে বের করেছে। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমেও নেতাদের দেওয়া হয়েছে প্রচুর অর্থ। কোনো কোনো নেতা এই অর্থ নিয়েছেন তার তালিকা ও প্রমাণপত্রসহ ইডি জমা দিয়ে।

পশ্চিমবঙ্গের চাঞ্চল্যকর সারদা অর্থ কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেসের বহিষ্কৃত সাংসদ কুনাল ঘোষ সারদা কা- তদন্তের জন্য নিযুক্ত ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে (ইডি) ৯১ পাতার একটি চিঠি দিয়েছেন। কারাগার থেকেই তিনি ওই চিঠি লিখেছেন।

কুনাল ঘোষ ওই চিঠিতে সারদা কা-ের সঙ্গে কারা যুক্ত, কে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন, কে কত নিয়েছেন সেসব কথা সবিস্তারে জানিয়েছেন।

এদিকে ইডির তদন্তে জানা গেছে, সারদার কর্ণধার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের অন্তত ৮০০ কোটি রুপি দিয়েছেন। ওই অর্থ কোন কোন নেতা পেয়েছেন তার বিস্তারিত প্রতিবেদনও দিল্লিøর ইডিতে চলে গেছে।

প্রতিবেদন দিয়েছিল এসএফআইও

সারদা গোষ্ঠীর কাজকর্ম রুখতে ব্যর্থতার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দায়ী করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত রিপোর্টে এসএফআইও বলেছে, সারদা গোষ্ঠী চিট ফান্ড সংক্রান্ত আইন ভেঙেছিল। ওই আইন অনুযায়ী অর্থলগ্নি সংস্থাগুলোর বেআইনি কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অর্থ দপ্তরের কর্তারা অবশ্য এসএফআইও-র ওই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের মতে, সারদা বা অন্য অর্থলগ্নি সংস্থাগুলো চিট ফান্ড নয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারও রাজ্যের হাতে নেই। সারদার নিয়ন্ত্রণ চেয়ে বাম আমল থেকে বারবার বিধানসভায় আইন পাস করে কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়। তৃণমূল আমলেও পাঠানো হয়েছে দুইবার। কিন্তু এখনও কেন্দ্র সেই বিষয়টি আমলে নেয়নি।

কেন্দ্রের কর্পোরেটবিষয়ক মন্ত্রকের অধীনস্থ এসএফআই সম্প্রতি সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত শেষ করে মন্ত্রকের কাছে গোপন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারদা গোষ্ঠী কোম্পানি আইন, সেবি আইন ছাড়াও ভারতীয় দ-বিধির বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করেছিল। পাশাপাশি চিট ফান্ড সংক্রান্ত আইন ‘প্রাইজ চিট্স অ্যান্ড মানি সার্কুলেশন স্কিম্স (ব্যানিং) অ্যাক্টও (১৯৭৮)’ ভেঙেছিল তারা। ওই আইন অনুযায়ী সারদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাজ্য সরকারেরই। এই আইনে রাজ্য সরকারেরই সারদার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি, এই ধরনের অর্থ বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে সেবি। এ নিয়ে রাজ্যের কোনো এখতিয়ারই নেই। বাম আমল থেকেই নতুন আইন তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বিধানসভায় বিল পাস করে কেন্দ্রে পাঠানোর পরও তা পড়ে থাকে দীর্ঘ কয়েক বছর।

সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর মমতার সরকার বাম আমলে করা আইন ফেরত নিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন ইন্টারেস্ট অব ডিপোজিটরস ইন ফিনান্সিয়াল অ্যাসটাবলিশমেন্ট বিল ২০১৩’ পাস করায়। কিন্তু সেই বিলও কেন্দ্রের অনুমোদন পায়নি। সংশোধন করে পুনরায় পাঠানোর পরও তা কেন্দ্রে পড়ে রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের আইনজীবীদের একাংশের মতে, সারদার বেআইনি কাজকর্ম আটকানোর অন্য যে সব পথ ছিল, তাও কাজে লাগায়নি মমতার সরকার।

সারদার বিরুদ্ধে কেন্দ্র অবশ্য কড়া ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। এসএফআইওর গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারদা কোম্পানি আইন ভাঙলেও ‘কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’ সংক্রান্ত সেবির আইন ভাঙার দায়েই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। কারণ এই আইনে শাস্তির মেয়াদ অপেক্ষাকৃত বেশি। এসএফআইওর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় দ-বিধিরও অন্তত ৯টি ধারায় সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। অপরাধে মদত দেওয়া, অপরাধের ষড়যন্ত্র, অসৎ পথে সম্পত্তি আয়ত্ত করা, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতারণা, হিসাব সংক্রান্ত তথ্য জাল করার মতো অপরাধ করেছে সারদা গোষ্ঠী।

মিথুন চক্রবর্র্তী ও অপর্না সেনকে জিজ্ঞাসাবাদ

সারদা কা-ে অভিনেতা এবং তৃণমূল সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে আগস্টে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। মুম্বাইয়ের ইডি দপ্তরে প্রায় ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। সারদা গোষ্ঠীর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। সেই সূত্রে তার সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর কী আর্থিক লেনদেন হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চান ইডির তদন্তকারীরা।

ইডিকে মিঠুন চক্রবর্তী অভিযোগ করে বলেন, চুক্তি মোতাবেক সারদা গোষ্ঠীর কাছে এখনও ২৪ লাখ রুপি পাওনা রয়েছে।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে ইডির জেরার মুখোমুখি হয়েছেন আরেক টালিউড অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। সারদার একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অপর্ণা সেন। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সংস্থার সঙ্গে তার আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

খেলার মাঠেও সারদার অর্থ

খেলার মাঠে বিভিন্ন ক্লাবে সুদীপ্ত সেন অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। সারদার অর্থের হদিস বের করতে ক্লাবকর্তাদের ডেকে পাঠাতে শুরু করেছে ইডি। ইডি সূত্রে জানা যায়, সারদার অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তারা কিছু নথি জমা দিয়েছেন। মোহনবাগান ক্লাবের কাছেও এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে সারদার চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তদন্তকারীদের। সারদা থেকে প্রায় ৫ কোটি রুপি নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্লাবে অর্থ দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। সারদার অর্থ ওই ক্লাবগুলো কীভাবে খরচ করেছে তা খতিয়ে দেখবে ইডি। ওই ক্লাবকর্তাদের অনেকেই শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বলে ইডি সূত্র জানায়।

সারদার সম্পত্তি

২০১৩ সালে চিট ফান্ড প্রতারণার তদন্তে নেমে সারদা গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগর পুলিশ। বিধাননগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজ্যের ১২টি জেলায় ২৫৬টি প্লটে প্রায় ১৭৫০০ ডেসিমেল জমি রয়েছে সারদা গোষ্ঠীর। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও একাধিক রাজ্যে জমি রয়েছে সারদার।

এর মধ্যে উড়িষ্যায় ৯টি প্লটে রয়েছে ১৩৬০ ডেসিমেল জমি। আসামের চারটি প্লটে রয়েছে ৩২৮ ডেসিমেল জমি। ত্রিপুরায় ৫৫০ ডেসিমেল জমি রয়েছে সারদা গোষ্ঠীর। এর বাইরেও রয়েছে সারদার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে বাজেয়াপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ।

যেভাবে প্রতারণার জাল বিছিয়ে ছিলেন সুদীপ্ত

পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেক থেকে রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায়ও প্রতারণার জাল ছড়িয়ে ছিলেন সুদীপ্ত সেন। ২০১৩ সালে তদন্তে নেমে এমন তথ্যই এসেছে পুলিশের হাতে। শুধুমাত্র সল্টলেক এলাকাতেই সাতটি সম্পত্তির হদিস মিলেছে। এর মধ্যে কোনোটিতে গভীর রাত পর্যন্ত চলত  বৈঠক, কোথাও রাখা হতো গুরুত্বপূর্ণ নথি। নির্দিষ্ট কয়েকজন পদাধিকারীর স্বাক্ষরিত এন্ট্রি পাস নিয়েই ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলত।

সল্টলেকের এফ ডি ব্লকের ৪৫৬ নম্বর বাড়িতে থাকতেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের পরিবার। কখনও কখনও গভীর রাতে সুদীপ্ত সেন আসতেন এই বাড়িতে। সঙ্গে থাকত সশস্ত্র রক্ষীরা।

এইচ এ ১৫৫, সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় বাড়ি। সল্টলেকের এ এল ব্লকের ৫০ নম্বর বাড়িটি ছিল সারদা গোষ্ঠীর গুদাম। এখানেই মজুত রাখা হতো সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ নথি।

সারদা গোষ্ঠীর কর্মীদের সঙ্গে সাধারণত গভীর রাতে বিধাননগরের মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে গোপন বৈঠক করতেন সুদীপ্ত সেন। বৈঠকের জন্য কর্মীদের আনা হতো বাইক অথবা অ্যাম্বুলেন্সে করে। সব বাইকেই ইংরেজিতে লেখা কে পি। অর্থাৎ কলকাতা পুলিশ। জানা যায়, কলকাতা পুলিশকে বেশ কয়েকটি মোটরবাইক দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। কয়েকটি রেখে দেওয়া হয়েছিল নিজেদের ব্যবহারের জন্য।

সারদা গোষ্ঠীর অর্থে তৃণমূলের নির্বাচন

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের খরচ বাবদ সারদা গোষ্ঠীর কাছ থেকে ১৩০ কোটি রুপি নিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সারদা গোষ্ঠীর মালিক সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে নেওয়া টাকা নিয়ে ওই নির্বাচনী বৈতরণী পার হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (সিবিআই) এ তথ্য জানায়।

সল্টলেকে সারদা গোষ্ঠীর কার্যালয় মিডল্যান্ড পার্ক থেকে ১৩০ কোটি রুপি পাঠানো হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। লেনদেনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মমতার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় ও সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া প্রাক্তন আইপিএস রজত মজুমদার।

১৩০ কোটি রুপি থেকে ৩৪ কোটি বণ্টন করা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের ২২৬ প্রার্থীকে। ভোটের খরচ জোগাতে প্রত্যেক প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৫ লাখ রুপি। আরও ৪১ কোটি রুপি অন্যান্য খাতে ব্যয় করা হয়।

হেলিকপ্টারে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নির্বাচনী প্রচারে যেতেন, তার খরচও যোগানো হয়েছিল সারদার অর্থে।

সারদার গোড়ার কথা

২০১৩ সালের এপ্রিলে সারদার অর্থ কেলেঙ্কারির কথা প্রথম ফাঁস হয়। সারদা পশ্চিমবঙ্গের একটি বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী সংস্থা। সাধারণ মানুষকে বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে তারা হাজার হাজার কোটি রুপি তোলে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ভাষার ১০টি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল কিনে নেয়। গত বছরের প্রথম দিকে ওই সব সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে গেলে সারদার আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস হয়। গত বছরের এপ্রিলে সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যান। পুলিশ পরে জম্মু ও কাশ্মীরের একটি হোটেল থেকে সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ও তার সংস্থার আরও তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। সুদীপ্ত সেনকে গ্রেপ্তারের পরই রাজ্যব্যাপী অর্থলগ্নিকারীরা তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার দাবি তোলেন। ওই অর্থ ফেরত দেওয়ার লক্ষ্যে বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশন গড়ে তোলেন। সেখানে সাড়ে ১৭ লাখ আবেদন জমা পড়ে। -এই সময়ের সৌজন্যে



মন্তব্য চালু নেই