‘কৃষকের কৃষক’ শ্যামনগরের সিরাজুল ইসলাম

আব্দুর রহমান,সাতক্ষীরা ॥ পড়াশুনার পাশাপাশি ছোট বেলাই বাবার সাথে ফসলের ক্ষেতে কৃষি কাজে হাতে খড়ি কৃষক সিরাজুল ইসলামের। এইচএসসি উত্তীর্ণের পর যোগ দেন সরকারি মৎস্য প্রজনন খামারে। জীবনের র্দীঘ সময় ধরে মৎস্য প্রজননে বিশেষ অবদান ও কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন হাঙ্গেরিতেও। ‘৮৮ সালের ঝড়ের পর নিজে নিজেই অবসরগ্রহণ গ্রহণ। কর্মজীবনে মৎস্য প্রজনন নিয়ে কাজ করলেও অবসরের পর শুরু করেন স্থানীয় জাতের ধান নিয়ে গবেষণা। স্থানীয় দুই শতাধিক ধানের জাত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে লবণাক্ত এলাকায় চাষ উপযোগী ধান জাত নির্বাচন পূর্বক তা সম্প্রসারণ করেছেন জেলার কৃষকদের মধ্যে। আদর্শ কৃষক হিসেবে প্রায় ১৫ বছর যাবত উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড ট্রেনার হিসেবেও কাজ করছেন। হয়ে উঠেছেন ‘কৃষকের কৃষক’। পেয়েছেন চ্যানেল আই কৃষি পদক।
সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের হায়বাতপুর গ্রামের শেখ আব্দুর রহিমের ছেলে।
কৃষক সিরাজুল ইসলাম কৃষি ও কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নে গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করে ২০০২ সালে নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন হায়বাতপুর সেবা কৃষক সংগঠন। পরে উপকূলীয় কৃষির ফসল পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিটি মৌসুমে কৃষকদের নিয়ে সভা করে সম্মিলিত উদ্যোগে ফসল চাষাবাদ শুরু করেন। নিজ গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামের কৃষকদের সকল প্রকার ফসলের বীজের চাহিদা পূরণে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন হায়বাতপুর সেবা কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে।
তার সংগঠনের নিয়ম ছিল কোন কৃষক যে কোন ফসলের বীজ নিলে চাষের পর ফসল হলে সমপরিমান বীজ আবারও কৃষক সংগঠনে ফেরত দিতে হবে। এভাবেই অসংখ্য কৃষক বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় করেন।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, কৃষকের বীজ নিরাপত্তার কথা ভেবে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডেজিনাস নলেজের (বারসিক) সহযোগিতায় এলাকায় চাষ উপযোগী ধানের জাত নির্বাচনে স্থানীয় ধান জাতের বীজ সংগ্রহ করে তার সংগঠনের দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। গড়ে তোলেন ‘স্থানীয় জাতের ধানের জাদুঘর’।
পর্যায়ক্রমে তিনি ২০০৭ সালে ৩৬টি, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ৩৯টি, ২০১০ সালে ৬০টি, ২০১১ সালে ৯৩টি, ২০১২ সালে ৭৬টি এবং ২০১৩ সালে ৬৩টি স্থানীয় ধান জাত নিয়ে গবেষণা করেন।
কৃষক সিরাজুল ইসলাম যেসব ধান জাত নিয়ে গবেষণা করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুটেপাটনাই, পাটনাই, তালমুগুর, ইঞ্চি, চরোবালাম, হামাই, হলদেগোটাল, বজ্রমুড়ি, ভুটেস্যালট, মরিচশাইল, মোতাআমন, কাজলশাইল জাঁইবালাম, ন্যাড়াজামাইনাড়–, হোগলা, মন্তেরশ্বর, হাতিরজোড়, জামাইনাড়–, সাদামোটা মহিনীস্যালট, লালগোটাল, দুধকলম, রূপেশ্বা, ক্যারেংগাল, কালোমোটা, ময়নামতি তেইশবালাম, দারশাইল, মগাইবালাম, খ্যাকশাইল, ঘুনসি, খেজুুরছড়ি, কালোজিরা, বালিয়াদিঘা, উড়িচেুতরা, তেজমিনিকেট, মনোহর, সাদাজাবড়া, ড়েপো, মাছরাঙা, ক্ষীরকুন, বানাগোচ্চা, সাদাস্বর্ণ, মেছিজাবড়া, সাদাবিরই, খাবুলদুহান, সতিন/রাধাকৃষ্ণ, মাল্ াআগুনাবিন্নিী, কাডিভিট, বাশমতি, বদ্দিরাজ, মালতি, স্বর্ণা, খাকিবিরই, ঘেউজ, দুধেশ্বার, সুভাস, মইরোম, চিনিসাগর, মহিমে, বেনাপোল, রাজাশাইল, সাদাগোটাল, কুমড়াগোড়, মালাগেতি, দূর্গাভোগ, গচি, গচ্চা, খাইনল, কলমিলতা, সিলেটবালাম, চিনিকানি, ভোলানাথ, নোনাকচি, হরি, ডাকশাইল, তিলেককচি, কাঠিগচ্চা, সাহেবকচি, কাচড়া, মুড়াবাজাল, রানীস্যালট, বাশফুলবালাম, চিনিকানাই, চাপশাইল, নারকেলমুচি, বিরই, বুড়োলক্ষèী চিনিশাইল, গুছা কাইশাবিন্নি, সদে, কুচমুচ, বগীআউশ, পুইট্রআইজং, রাইতুল, চাইনাইরি, আব্দুল হাই, বুড়োলক্ষী, হুলোবাবুই প্রভৃতি।
কৃষক সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, চলতি বছরের ১৪ মার্চ তার জীবনে স্মরণীয় একটি দিন। এদিনই চ্যানেল আইয়ের কার্যালয় চত্বরে এক অনাডম্বর অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ তার হাতে তুলে দেন চ্যানেল আই কৃষি পদক।
এর আগে ২০১০ সালের ৫ আগস্ট শ্যামনগরে কৃষক ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে এসে তার ধানের জাদুঘর দেখে অভিভুত হয়েছিলেন শাইখ সিরাজ। সে সময় কৃষকদের সংগঠিত করে তার উদ্যোগকে আরো শক্তিশালী করার জন্য ১ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন।
আমিও জলাবদ্ধতা-ঝড় এবং লবণাক্ততা সহনশীল ১৪টি স্থানীয় জাতের ধান বীজ শাইখ সিরাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করেছিলাম, যোগ করেন তিনি।
সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন কৃষক সিরাজুল ইসলামের কর্মযজ্ঞ নিয়ে বলেন, বর্তমানে তার নেতৃত্বে শ্যামনগর উপজেলায় আমন-আউশ ও বোরো মৌসুমের প্রায় ২ শতাধিক ধানের জাত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে এলাকা উপযোগী ধান জাত নির্বাচনে গবেষণা করছেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা। গবেষণার ফলাফল হিসেবে প্রাপ্ত লবণাক্ত এলাকায় চাষ উপযোগী ধান জাতের বীজ কৃষক থেকে কৃষক, গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নে ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর প্রায় ২০টি কৃষক-বনজীবী-জেলে-আদিবাসী ও যুব সংগঠনের সমন্বয়ে শ্যামনগরে তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কেন্দ্র। যা লোকায়ত জ্ঞান চর্চা করে উপকূলীয় এলাকার অতিরিক্ত লবণাক্ততা, ঘণ ঘণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকার সংগ্রামে মডেল হতে পারে যেকোন অঞ্চলের জন্য, দেশের জন্য।
স্থানীয় পরিবেশ গবেষক শাহীন ইসলাম বলেন, কৃষক সিরাজুল ইসলাম দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মডেল। তার নেতৃত্বে উপকূলীয় কৃষকরা ধান নিয়ে যে গবেষণা করছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে যে আন্দোলন করছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলের খালগুলো মিষ্টি পানি সংরক্ষণে ব্যবহার করে স্থানীয় কৃষকদের আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া আহবান জানান।
পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ও শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় জাতের ধান বীজ নিয়ে তাদের যে কাজ তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সহায়ক। বিশেষ করে লবণাক্ত এলাকায় তো বটেই।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী হোসেন বলেন, শ্যামনগরে উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কেন্দ্র যে কাজটি করছে তা আমাদের জন্যও অনেক সহায়ক। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় এখানে ফসল ফলানো অনেক কষ্টকর। সেই প্রেক্ষিতে সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে অন্যান্যরা কৃষকদের যে পরামর্শ দেন তা বেশ সাফল্যজনক।



মন্তব্য চালু নেই