কী হয় এখন সাদ্দাম হোসেনের সেই প্রাসাদে?

ইরাকের বাসিন্দা ইয়াজান ফাদলি বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। যেখানেই তিনি তার জন্মভূমির পরিচয় দেন, সঙ্গে সঙ্গেই লোকজনের মনে তৈরি অসংখ্য প্রশ্ন। তাদের কাছে ইরাক মানেই ইসলামিক স্টেট (আইএস), ইরাক মানেই গোষ্ঠিগত সহিংসতা, রাসায়নিক অস্ত্র আর গাড়িবোমা বিস্ফোরণ।

ইরাকের আরেকটা পরিচয় এখন আর ফুটে ওঠেনা। এই ইরাক হচ্ছে মেসোপটেমীয় সভ্যতার দেশ। গণিত, জোতির্বিদ্যা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো শাস্ত্রগুলোর জন্মভূমি এই দেশটি। শুধু তাই নয়; বিজ্ঞান, শিল্পকলা আর স্থাপত্যবিদ্যায় অবদান রাখা বাঘা বাঘা সব সম্রাটের জন্মও ইরাকে।

বিষয়টি নিয়ে বলছিলেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সেথ ক্যানটে। তার ভাষায়, ‘নানা কারণেই ইতিহাসে ইরাক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হচ্ছে- ইতিহাসের শুরুর দিকের কিছু সভ্যতার জন্ম এই ভূখণ্ডে।’ এক সময় ইরাক উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থান ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে গত কয়েক দশকে পুরোপুরি পাল্টে গেছে সেই ইরাক। বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সংবাদে প্রধান শিরোনাম হয়েছে দেশটি। সেটা কোনো ইতিবাচক কারণে নয়। যুদ্ধ, সহিংসতা, বোমা হামলা- এসবই ছিল ইরাক নিয়ে গণমাধ্যমগুলোর খবরে।

ইরাকের বাগদাদ শহরে জন্ম ইয়াজান ফাদলির। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনীর অধীনে অনুবাদকের কাজ করেছেন তিনি। ইয়াজান বলেন, ‘১৯৮০ সাল থেকে আমরা যুদ্ধের যে ভোগান্তিতে আছি, তার কারণে গণমাধ্যম এবং মার্কিন সরকার আমাদের দেশের খারাপ বিষয়গুলোকে বেশি বেশি তুলে ধরেছে। তারা কখনো আমাদের ইতিহাস তুলে ধরেনি।’

তবে নতুন একটি জাদুঘর হয়তো মানুষের মনে ইরাক সম্পর্কিত সেই বাজে ধারণাগুলো বদলে দিতে পারে। এই জাদুঘরটি খোলার মধ্য দিয়েই হয়তো ইরাক আবার তার স্বর্ণোজ্জল ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে পারবে। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেস্বর ইরাকের তেল সমৃদ্ধ বসরা নগরীতে উদ্বোধন করা হয়েছে ‘বসরা মিউজিয়াম’ নামের জাদুঘরটি। গত কয়েক দশকে দেশটিতে স্থাপিত এটাই প্রথম কোনো জাদুঘর।

বসরার ঠিক যে জায়গায় জাদুঘরটি অবস্থিত সে জায়গাটিও অসংখ্যবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। এটা মূলত ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের সেই বিখ্যাত প্রাসাদ ‘লেকসাইড প্যালেস’। ক্ষমতায় থাকতে এমন প্রায় ১০০টির মতো প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন সাদ্দাম। লেকসাইড তারই একটি।

জাদুঘরের পরিচালক কাহতান আল ওবায়েদ জানান, তিনি বুঝশুনেই এই স্থানটি বেছে নিয়েছেন। স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক এবং মানবতা ও সভ্যতার সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতার মতো বিষয়গুলো থাকার পরিবর্তে জাদুঘর প্রতিস্থাপনকেই সঠিক বলে মনে করেন কাহতান।

গত আট বছর ধরে জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের বক্তব্য, এটি ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় ইতিহাসকে তুলে ধরবে এবং বসরা শহরের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনকে উৎসাহিত করবে। তবে অর্থ-সঙ্কটের কারণে জাদুঘরের সবগুলো প্রদর্শনীকক্ষ এখনই চালু করা যাচ্ছে না। মাত্র একটি গ্যালারি খোলা হয়েছে। এখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে ২০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন সব শিল্পসামগ্রী। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রূপার মুদ্রা, তৈজসপত্র, কফিন এবং মেঝে ও দেয়ালে ব্যবহৃত টাইলস।

জাদুঘরটি যখন পুরোপুরি চালু হবে তখন এতে থাকবে বিভিন্ন ধরনের সাড়ে তিন থেকে চার হাজার প্রাচীন নিদর্শন। তিনটি প্রদর্শনীকক্ষে প্রদর্শন করা হবে ব্যবিলনীয়, অ্যাসেরীয়, সুমরীয় এবং ইসলামি সভ্যতার সব গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম। এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করতে পারা ছিল এক ধরনের বিজয়। তবে এজন্য অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরোতে হয়েছে কাহতানকে।

গত এপ্রিলে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠিগুলো লেকসাইড প্যালেস দখল করে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল। ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের পর থেকে এই প্রাসাদটিকে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতো ব্রিটিশ সৈন্যরা। এখনো এখানে গাড়িবোমা হামলার ভয় আছে। গত কয়েক দশকে ইরাকে কর্তৃত্ববাদী শাসন, বিদেশি হস্তক্ষেপ, গোষ্ঠিগত লড়াই এবং সম্প্রতি আইএসের উত্থান দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, অবকাঠামো ভেঙে গেছে।

২০০৮ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা ইরাক ছেড়ে যাওয়ার পর কাহতান এবং স্থানীয় ইরাকিরা মিলে শুরু করে জাদুঘর নির্মাণের জন্য দৌড়ঝাঁপ। প্রচারণা, তহবিল সংগ্রহ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো কাটিয়ে জাদুঘরের কাজ সামনে এগিয়ে নিতে হয়েছে তাদের। এর মধ্যে নির্মাণের অনেক জিনিসপত্র লুটের চেষ্টা করা হয়েছে। সেসব রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করতে হয়েছে তাদের।

সব বাধা অতিক্রম করে বসরা মিউজিয়াম এখন ইরাকিদের জন্য একটি গর্বের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাদলি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের ইতিহাস জানার জন্য বসরা জাদুঘর অনেক সাহায্য করবে এবং বিশ্বের কাছে ইরাকের ভিন্ন চিত্র তুলে ধরবে।’ একে ‘অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে একটুখানি আলো’ বলে অভিহিত করেন তিনি। ফাদিল বলেন, ইতিহাসবিহীন জাতির কোনো ভবিষ্যত থাকে না। এই জাদুঘর আমাদের আশাহত না হওয়ার কথা শেখাবে।



মন্তব্য চালু নেই