কি অপরাধ ছিল ছোট্ট আনিসার? যার জন্য হারাতে হলো দু’হাত
টিপু সুলতান (রবিন), সাভার থেকে: যে বয়সে অন্য শিশুদের সাথে দৌড়-ঝাপ করে খেলার কথা ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে শিশু আনিসার। চার বছর বয়সী ছোট্ট ফুটফুটে এই শিশুটি এক বছর আগে আশুলিয়ার কুঁড়গাও এলাকার জনৈক শাহবুদ্দিনের বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়ে এক হৃদয় বিদারক দূর্ঘটনার শিকার হয়। ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে টানা বৈদ্যুতিক লাইনের তারে জড়িয়ে হারায় তার দুটি হাত। খেলার সামগ্রী মনে করে ছাদ ঘেঁষে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাগানো চীনা মাটির তৈরি বাটি ধরতে গিয়েছিলো সে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই এগার হাজার ভোল্টের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয় আনিসা। প্রথমে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হলেও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার্ড করা হয়। সেখানে এক মাস চিকিৎসার পর কেটে ফেলতে হয় আনিসার কোমল দুটি হাত।
কিন্তু শরীরের মূল্যবান অঙ্গ দুইটি হারানোর পরও যেন সেই চাঁপা কষ্টটাকে ভুলতে শিখেছে ছোট্ট আনিসা। হাত ছাড়া কিভাবে পড়াশুনা ও নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করবে সেই চেষ্টাই সর্বদা তার। স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পা দিয়েই লেখা ও ছবি আঁকতে শিখেছে সে। পাশাপাশি অন্যসব দরকারি কাজও করতে পারার চেষ্টা করে অবুঝ আনিসা। উঠনের এদিক থেকে ওদিক হাত ছাড়াই ছুটোছুটি করে মেয়েটি। দেখে মনে হয় কোন প্রতিবন্ধকতাই আনিসার শৈশবকে থামিয়ে রাখতে পারবেনা। কে বা কারা তার এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী যা সে জানেনা। শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় অদম্য এই মেয়েটি। হঠাৎ পত্রিকায় আসা কোন প্রতিবন্ধীর সফলতার কাহিনী শুনে চোখ আনন্দে জ্বলে উঠে তার। সে ভাসতে চায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে। আর অকালে পঙ্গুত্ব বরণ করে নেওয়া ছোট্ট শিশুটির বেঁচে থাকার এই অদম্য সাহসিকতা দেখে আশার আলো পায় পরিবার। তাই সাভারের পক্ষাঘাত গ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)-তে প্লে শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষায়ও অংশ গ্রহণ করানো হয় আনিসাকে। সেখানে অন্য শারিরীক প্রতিবন্ধীদের কৃত্রিম হাত দেখে বাবা-মা’র কাছে বায়না ধরে মেয়েটি। তারও একটি এরকম হাত লাগিয়ে দিতে হবে। তাইতো লাজ ভুলে মেয়ের কৃত্রিম হাত সংযোজনে আর্থিক সহায়তার জন্য হাত বাড়িয়েছেন সমাজের বিত্তবানদের কাছে। কেননা কৃত্রিম হাত সংযোজনে যে কমপক্ষে ২০লাখ টাকা লাগার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যা গার্মেন্ট শ্রমিকের এই পরিবারটির পক্ষে ব্যয় অসম্ভব।
কিন্তু সেদিন ঠিক কি হয়েছিল আনিসার সাথে? এমন প্রশ্নের জবাবে কেঁদে ফেলেন তার মা রিতা বেগম। আনিসার জায়গা থেকে নিজেকে কল্পণা করে কন্ঠরোধ হয়ে আসে তার। কিভাবে তার ছোট্ট আনিসা এই কষ্ট সহ্য করে আছে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানেনা তিনি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অঝোরে কেঁদে ফেলেন তিনি। আর মা’র মুখপানে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট আনিসা। হয়ত বা বোঝেনা সমাজের কোন নিষ্ঠুর পাশবিকতার শিকার হতে হয়েছে তাকে? যার কারণে তাকে বলি দিতে হয়েছে শরীরের কোমল মূল্যবান অঙ্গ। অবশেষে চোখের পানি আঁচলে মুছে সেই দিনের ভয়াল দূর্ঘটনার বর্ণনা দেন আনিসার মা।
২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারী বিকেলে কুঁড়গাও এলাকার জনৈক শাহাবুদ্দিনের মেয়ের সাথে তাদেরই বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়েছিলো তার দুরন্ত মেয়ে। এসময় ছাদের কিনারে থাকা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক তারের খুঁটিতে ব্যবহৃত চীনা মাটির তৈরি গোল বাটির দিকে নজর যায় আনিসার। অবুঝ দুরন্তপনা আনিসা এটিকেই খেলার সামগ্রী ভেবে বসে। ছুটে সেই বাটির নিকটে যেতেই এগারো হাজার ভোল্টের তার টেনে নেয়ে তার মেয়ের কঁচি দুটি হাত। ছিটকে পরে সঙ্গা হারিয়ে ফেলে সে। এসময় আনিসার দুটি হাত স্পৃষ্ট হয়, ভেঙ্গে যায় ডান পা। পরে বাড়ির অন্য ভারাটিয়াদের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ৮ দিন চিকিৎসার পর তাকে ভর্তি করা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তার মেয়ের দুটি হাত কেটে ফেলা হয়।
আনিসার বাবা আলহাজ্ব আলী আওয়ার নিউজকে বলেন, এঘটনার জন্য এলাকাবাসীসহ তারা আনিসার এই অকাল পঙ্গুত্বের জন্য বাড়ির মালিককে দ্বায়ী করেন। কেননা বাড়ির মালিক শাহাবুদ্দিনের অবৈধ পন্থায় ভবন নির্মাণসহ চরম অসাবধানতাই আনিসার এমন অবস্থার জন্য দ্বায়ী। সেসময় থানায় কোন অভিযোগ করা যাবেনা এমন শর্তে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় শাহাবুদ্দিন। সেই সাথে মৌখিকভাবে আনিসার ভবিষ্যতের যাবতীয় খরচ বহন করারও মিথ্যা অঙ্গীকার করেন বাড়ির মালিক শাহাবুদ্দিন। এরপর এত দিন কেটে গেলেও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহাবুদ্দিন প্রভাবশালী হওয়ায় তার পঙ্গু মেয়ের দিকে আর চোখ মেলেও তাকান না। এমনকি রাস্তায় দেখা হলেও না দেখার ভান করে চলে যান তিনি ও তার স্ত্রী।
তাহলে কি তার ছোট্ট এই মেয়েটির অকাল পঙ্গুত্বের জন্য কেউ দ্বায়ী নন? নাকি যাদের অসাবধানতা ও অপরিকল্পিত ভাবে বৈদ্যুতিক খুঁটি ঘেষে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন তারা দ্বায়ী। যাদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক লাইনের তার নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছাদের একাংশের উপর দিয়ে। বাড়ির যে অংশ দিয়ে বৈদ্যুতিক তার গেছে সেখানে কি কক্ষ না বানালে হতোনা। তা না করুক, ওই জায়গাটা কি আড়াল করে রাখা যেত না। হ্যাঁ, হয়ত বা যেত। আর সেটি করলে আজ তার মেয়েকে এভাবে শরীরের অঙ্গ হারাতে হতনা। কেন করবে? করলে তো স্বার্থে ব্যঘাত ঘটবে ও আর্থিক ক্ষতি হবে। তবে সেই ক্ষতির মূল্য কি তার ছোট্ট আনিসার দুটি হাতের চেয়েও বেশী? এত সব প্রশ্ন ও তার উত্তর নিজেই দিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি আনিসার বাবা আলহাজ্জ আলী।
কিন্তু কেনই বা আনিসার মত ছোট্ট শিশুরা অকালে পঙ্গু হবে? কেনইবা সমাজের শিক্ষিত মুখশধারী এসব স্বার্থকাঙ্গাল মানুষের ভুলের কারণে তাদের সারা জীবন এমন ভাবে অন্যর করুনায় বেঁচে থাকতে হবে এই প্রশ্ন বিবেকের কাছেই থাক…!
মন্তব্য চালু নেই