কন্যার নতুন শ্রী, বালা পরো তো দেখি

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন। তাই কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় থাকা স্কুলছাত্রীদের গয়না পরাতে চলেছে রাজ্য সরকার।

কী রকম? কোটি কোটি টাকা খরচ করে সোনালি রংয়ের বালা গড়াতে দিয়েছে সরকার। প্রশাসন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী নিজে বালার ডিজাইন ঠিক করে দিয়েছেন। বালার উপরে বাংলা এবং হিন্দিতে লেখা থাকছে ‘কন্যাশ্রী’।

এ বালা কীসের বালা? কন্যাশ্রীর ওয়েবসাইট বলছে, সোনার জল করা ধাতুর বালা। তবে রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জানাচ্ছেন, “সোনা নয়, সোনালি রংয়ের ধাতু। সোনা দেওয়ার মতো অর্থ সরকারের নেই।”

আপাতত তবে কতটা অর্থ আছে? কলকাতার ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে যে সংস্থাটি কাজের বরাত পেয়েছে, তাদের দাবি, ৫৬ থেকে ৫৮ মিলিমিটার বৃত্তের এক-একটি বালার ওজন প্রায় ১৮ গ্রাম। আনুমানিক দাম ৪০ টাকার কাছাকাছি। সব মিলিয়ে বরাত পাওয়া বালা গড়তে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। সমাজকল্যাণ দফতরের পাল্টা দাবি, একটি বালার দাম পড়ছে ২৩ টাকা। সেই হিসাবে ১৬ লক্ষ বালা তৈরি করতে খরচ হবে ৪ কোটি টাকার মতো।

গোড়া থেকেই ‘কন্যাশ্রী’ মুখ্যমন্ত্রীর সাধের প্রকল্প। নামকরণ থেকে লোগো ডিজাইন, সবই তাঁর করা। এ বার বালা পরানোর পিছনেও তিনি। নইলে কিশোরী মেয়েদের স্কুলছুট আটকানো যে প্রকল্পের লক্ষ্য, সেখানে তাদের হঠাৎ বালা পরানো হবে কেন, এ প্রশ্ন প্রশাসনের অন্দরেও উঠেছিল। মন্ত্রী নিজেই জানাচ্ছেন, প্রথমে ঠিক ছিল ছাত্রীদের প্রত্যেককে ব্যাজ দেওয়া হবে। পরে মুখ্যমন্ত্রীই পরামর্শ দেন, মেয়েরা গয়না-টয়না পছন্দ করে। তাই বালা দেওয়া হোক। মন্ত্রীর কথায়, “যেমন ভাবে পরিচয়পত্র বা মেডেল দেওয়া হয়, তেমনই প্রকল্পের আওতায় থাকা ছাত্রীদের সম্মান জানাতে বালা দেওয়া হচ্ছে।”

আসল উদ্দেশ্যটা অবশ্য কবুল করলেন সমাজকল্যাণ দফতরের অন্য এক কর্তা। তাঁর বক্তব্য, ছাত্রীদের গয়না পরিয়ে কন্যাশ্রীর সাফল্য প্রচার করাই সরকারের লক্ষ্য। তেরো থেকে আঠেরো বছরের কমবয়সী মেয়েরা যাতে বিয়ে বা অন্য কোনও কারণে পড়াশুনো বন্ধ করে না-দেয়, তা নিশ্চিত করতে বছর দুয়েক আগে কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করেছিল সরকার। যে পরিবারের বার্ষিক আয় বছরে

১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার মধ্যে, তাদের মেয়েকে পড়ানোর জন্য বছরে ৫০০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হয়। আঠেরো বছর পেরোনোর পরেও পড়াশুনো চালিয়ে গেলে মেলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা। নবান্ন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই প্রায় ২২ লক্ষ ছাত্রী এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছে।

সমাজকল্যাণ দফতরের একাংশ জানাচ্ছেন, টিভি বা অন্যান্য মাধ্যমে এই প্রকল্প নিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হলে যা খরচ হতো, তার চেয়ে বালা পরিয়ে অনেক কম টাকায় অনেক বেশি কার্যকরী প্রচার চালানো সম্ভব হবে। ধাতুর ওই বালা মেয়েরা সারাক্ষণই হাতে পরে থাকবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

বিজ্ঞাপন-বিশেষজ্ঞ শৌভিক মিশ্র বলছেন, বিজ্ঞাপনের দু’রকম কৌশল হয়। ‘অ্যাবভ দ্য লাইন’ আর ‘বিলো দ্য লাইন’। হোর্ডিং, টিভি, রেডিও ইত্যাদি প্রথম দলে পড়ে। বালা পরানোর কৌশলটি দ্বিতীয় দলের। শৌভিকের মতে, “বিজ্ঞাপনের দিক থেকে এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরী। কিন্তু এর ফলে ছাত্রীরা অজ্ঞাতেই যে ভাবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হয়ে যাবে, সেটা ঠিক নয়।”

প্রশাসনেও অনেকেরই প্রশ্ন,  সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সেটা ফলাও করে জাহির করার দায় গ্রাহককে নিতে হবে কেন? সাহিত্যিক বাণী বসু মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তা কিন্তু বেশ কম। সেখানে আগ বাড়িয়ে বাচ্চাগুলোর হাতে গিল্টি করা বালা দেওয়াটা উচিত নয়।” নারী আন্দোলনের কর্মীদের একাংশের মতে, কম বয়সে বিয়ে আটকানো কন্যাশ্রীর অন্যতম উদ্দেশ্য। সেখানে মেয়েদের সরকারি গয়না পরিয়ে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে? সমাজকর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “বালার মতো গয়না দেওয়াটা বাচ্চাগুলোকে মেয়েলি ভূমিকায় বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা বলেই মনে করছি।”

সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া অভিনেত্রী অঞ্জনা বসু থেকে ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ চন্দ্রাণী সিংহ ফ্লোরা বা প্রবীণ বিজ্ঞাপন-বিশেষজ্ঞ রাম রে, সকলেরই বক্তব্য “প্রকল্পের উদ্দেশ্য যেখানে পড়াশোনা, টাকাটা সেই দিকেই খরচা হওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল।” রাম সরাসরিই বললেন, “এই সিদ্ধান্তটা অত্যন্ত বোকা বোকা।” অঞ্জনার প্রশ্ন, “বালা দিয়ে এঁরা কী প্রমাণ করতে চাইছেন?”

প্রশ্ন-সংশয় যতই থাক,    মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণে আপাতত গোটা প্রশাসন আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছে। সূত্রের খবর, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বালা-প্রকল্প মঞ্জুর হয়। জেলাওয়ারি যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ৪০ লক্ষ    টাকা পাচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনা। তালিকায় পরের নাম নদিয়ার। বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৩৫ লক্ষ টাকা। বর্ধমান পাচ্ছে প্রায় ৩৩ লক্ষ এবং দক্ষিণ     ২৪ পরগনার জন্য থাকছে প্রায়    সাড়ে ৩২ লক্ষ টাকা। সব জেলা মিলিয়ে মার্চের মধ্যে মোট ৪ কোটি টাকা খরচ করা হবে জানিয়েছেন দফতরের এক কর্তা। দফতরের     সচিব রোশনী সেন জানান, কয়েকটি জেলায় ইতিমধ্যেই বালা বিতরণ করা হয়ে গিয়েছে। তিনিই বলেন, “বালার নকশা ঠিক করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অনুমতি পেয়েই বালাগুলি অর্ডার দেওয়া হয়েছে।”

সরকারি কোষাগারের অবস্থা যতই সঙ্গীন হোক না কেন, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাপূরণেই ফি-বছর কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে মেলা-খেলা-উৎসব-খয়রাতিতে। মুখ্যমন্ত্রী চান বলেই প্রতি বছর নানাবিধ ‘ভূষণ’ আর ‘রত্ন’ পুরস্কার দিতে জলের মতো টাকা খরচ হয়। নবান্নেই গুঞ্জন, এ বার কন্যা-ভূষণে একটা ‘আইটেম’ বাড়ল, এই আর কী!

বিরোধী শিবিরে কেউ কেউ মুচকি হেসে বলছেন, “শুধু গাইঘাটা নয়, মমতাবালা এখন ঘরে ঘরে!”

 



মন্তব্য চালু নেই