এমন বন্ধু থাকলে আওয়ামী লীগের শত্রুর কী দরকার !

মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের মতো ‘বন্ধু’ থাকলে আওয়ামী লীগের শত্রুর দরকার আছে বলে মনে হয়না৷ আওয়ামী লীগ যদি ‘পতন’ চায়, তা নিশ্চিত করার জন্য এমন দু-চারজনই যথেষ্ট৷

এক গ্রামে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত এক লোক ছিল৷ এক বিকেলে তিনি গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হন হন করে হাঁটছেন৷ পথেই গ্রামের স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে দেখা৷ নীতিপরায়নতার জন্য এলাকার সবার কাছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ওই লোকটির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, ‘‘এত তাড়া কিসের, আস্তে হাঁটুন, পা হড়কে পড়ে যাবেন তো!” কথা শুনে সেই লোক মহাবিরক্ত৷ ‘‘সবার সঙ্গে মাস্টারি! আমি যেভাবে খুশি হাঁটবো, আপনার কী – ” এই বলে আরো জোরে হাঁটতে শুরু করলেন এবং তাতে যা হওয়ার তা-ই হলো, শিক্ষকের কথা বাসী হবার আগেই বেচারা পা হড়কে একেবারে ধানক্ষেতের কাঁদায়! সেদিনের পর নাকি লোকটি সুজন-কুজন চিনতে শিখেছিল৷

কিন্তু আওয়ামী লীগ কি তা শিখছে? সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার কথা বলার এতদিন পরেও ক্ষমতাসীনরা তাহলে নীরব কেন? সরকার এবং সজীব ওয়াজেদ জয়-এর সমালোচনা করে জাফর ইকবাল কি তাদের বেশি ‘বিরক্ত’ করে ফেলেছেন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কি গল্পের ওই লোকটির মতো ভাবছেন, ‘‘আমরা যা খুশি বলবো, যা খুশি করবো, আপনার কী?”

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)-র শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে অপদস্থ করতে ‘যা খুশি’ই করছে সিলেট আওয়ামী লীগ৷ জাফর ইকবালবিরোধী একাধিক মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছে তারা৷ সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী , শাবিপ্রবি-র উপাচার্য-বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখাই নাকি জাফর ইকবালের বড় ‘অপরাধ’৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাবকারীও তিনি৷ তাই সিলেটের কিছু মানুষ অসন্তুষ্ট৷ কয়েকদিন আগে ‘সিলেটবাসী’ ব্যানারে জাফর ইকবাল-বিরোধী মিছিল হয়েছে৷ মিছিলটির নেতৃত্বে ছিল নাকি সিলেট আওয়ামী লীগ৷

মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস সিলেটের সাধারণ মানুষকে জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে উঠে-পড়ে লেগেছেন৷ একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও তাই তিনি বলতে পারলেন, ‘‘জাফর ইকবাল চায় না এই সিলেটের মানুষ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোক৷ আর সিলেটের মানুষ তাঁকে ফুল চন্দন দিয়ে, প্রত্যেক দিন সুন্দর সুন্দর ফুল নিয়ে প্রত্যেক দিন মূর্তি পূজা করতে যায়৷…. আমি যদি বড় কিছু হতাম, তাহলে ধরে তাকে ইকবাল) চাবুক মারতাম৷” শিক্ষককে চাবকানোর কথা বলতে একটুও বাঁধেনি কয়েস সাহেবের৷ তাঁর এই ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের বিষয়ে নীরব থাকতে আওয়ামী লীগেরও রুচিতে বাঁধছে না৷

ছাত্র লীগের নেতৃত্বেও জাফর ইকবাল-বিরোধী মিছিল হয়েছে সিলেটে৷ প্রতিবাদ মিছিল৷ কিসের প্রতিবাদ? ব্লগার অভিজিৎ হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের মন্ত্রীদের নীরবতার সমালোচনা করেছেন অনেকেই৷ সেই সমালোচনার জবাবে সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে কিছু কথা বলেছেন, যা অধ্যাপক জাফর ইকবালের উচিত মনে হয়নি৷ তাঁর মনে হয়েছে, জয়ের মন্তব্য ব্লগার হত্যায় মৌলবাদীদের আরো উৎসাহিত করতে পারে ৷

মুশকিল হলো, বাংলাদেশে কখনো কখনো শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া তো বটেই, এমনকি তাঁদের সন্তানের সমালোচনা করাও মহা অন্যায়৷ সজীব ওয়াজেদ জয়ের সমালোচনা করায় দলকানাদের চোখে জাফর ইকবালও বোধহয় এখন ঘোরতর ‘অন্যায়কারী’৷ তাই তাঁর বিরুদ্ধে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস সাহেব যা খুশি বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এর বিরুদ্ধে কিছু বলছেননা, করছেনওনা৷ ব্লগার হত্যা ছাড়াও কত কিছুই তো ঘটছে দেশে৷ কত নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হলো, পুলিশ নারীকে পেটালো – ইস্যু তো কম ছিলনা! সিলেট ছাত্র লীগ তার বেলায় চুপ৷ শুধু জাফর ইকবালের বিরুদ্ধেই তাঁদের যত লম্ফঝম্ফ৷ আর সরকার নীরব-নিথর-নিশ্চুপ!

সিলেটে ছাত্রলীগের মিছিলে অধ্যাপক জাফর ইকবালকে ‘কুলাঙ্গার বলে ভীষণ জ্বালাময়ী ভাষণ শুরু করেছিলেন একজন৷ শুরুতেই বলছিলেন, জাফর ইকবাল নাকি কোন নেতার উদ্দেশ্যে কটূক্তি করেছেন৷ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘‘কী কটূক্তি করেছেন জাফর ইকবাল?” বক্তব্য মুখস্থ করে আসা তরুণ নির্লজ্জের মতো হেসে তখন স্বীকার করেছেন, কটূক্তির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না৷

সিলেট ছাত্র লীগের কথিত ওই কর্মী বা নেতার প্রকৃত পরিচয়টা জানা হয়নি৷ তবে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের অতীত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য জানতে পারলাম৷ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর বাবা দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী (শিরু মিয়া) নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেঞ্চুগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন ৷ স্বাধীনতা বিরোধীর সন্তান বলেই কি কয়েস সাহেব স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন?

বাংলাদেশে দলবাজি না করলে সফল হওয়া যায়না৷ ওপরে উঠতে হলে কোনো না কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করতেই হয়৷ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তা করতে পারেন না বলেই হয়তো তিনি মৌলবাদীদের তো শত্রুই, আওয়ামী লীগেরও ‘প্রিয় বন্ধু’ হতে পারছেন না৷ অবশ্য নিজের বিবেক, মান-মর্যাদা কারো কাছে ‘ইজারা’ দেননি বলে তিনি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আগেও বেশ কয়েকবার দুর্জনদের রোষানলে পড়েছেন৷ শাবি থেকে যে পদত্যাগ করেছিলেন সে-ও বেশিদিন আগের কথা নয়৷ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করেই তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিলেন৷ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এখনো একা নন৷ সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁর পক্ষে লিখছেন অনেকেই৷ জাফর ইকবালের জন্য এমন বন্ধুরাই যথেষ্ট৷ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দুর্বিনীতদের ‘বন্ধু’ মেনে ‘সময় বুঝে’ নীরব, নিষ্ক্রিয়ই থাকুন! ডিডাব্লিউ



মন্তব্য চালু নেই