এবার পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতার কঠোর সমালোচনা করে যা বললেন তসলিমা

ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন নানা সময়ে নানান আলোচিত বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। অনেকে তার কঠোর সমালোচনার মুখেও পড়েন। এবার পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে তসলিমা নাসরিন কঠোর সমালোচনা করে সর্বশেষ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

আওয়ার নিউজ বিডির পাঠকদের জন্য তসলিমা নাসরিনের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

পাচু রায়ের নামটা জানতাম। এ পাচু চন্দ্রবিন্দুহীন পাচু। সেই বিরানব্বই সাল থেকে কলকাতার পত্র পত্রিকায় আমার পক্ষে চমৎকার চমৎকার চিঠিপত্র লিখতেন। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি আলাপ পশ্চিমবঙ্গে আমার বই ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর। মুসলিমমৌলবাদীতোষণের উদ্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিল। তখন ২০০৪ সালে। পাচু রায় ঘন কালো চুলের আপোসহীন বিপ্লবী। চারদিকে বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বলছেন, নানা মঞ্চে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে সিপিএমের গুষ্ঠি উদ্ধার করছেন।

আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। মুগ্ধ হয়ে তাঁর ভাষণ শুনি। পাশে বসে চা পান করতে করতে তাঁর নকশাল জীবনের নানা গল্প শুনি।পাচু পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্টদের কম্যুনিস্ট বলেই মানেন না। ওঁদের নানান ভুলত্রুটি ধরেন। পাচু চরম বামের বাম। পাচু তখন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। অবসর জীবনেও দিনরাত ব্যস্ত, লিখছেন, পড়ছেন, বক্তৃতা করছেন, নাটক দেখছেন, রাজনীতি সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গভীর গভীর আলোচনা করছেন। পাচুকে দেখছি, পাচু দুনিয়ার সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। পাচু নিঃস্বার্থ,নির্লোভ। পাচুর প্রতি শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় আমার এমনই গলে যাওয়ার মতো অবস্থা যে ওঁর লেখা কিছু কলাম জড়ো করে একটা বই বের করার কথা ভাবি। আমার তো যেই ভাবা সেই কাজ। আমার প্রকাশককে অনুরোধ করি একটা বই করে দিতে। অনুরোধ রাখলেন প্রকাশক। পাচু ওদিকে খুব দ্রুতই আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলেন। পাচুকে এত আপন ভাবতাম যে, কলকাতায় যে একটা বাড়ি কিনেছিলাম, সেটা আমার নামে কেনা যায়নি বলে পাচুর নামে কিনেছিলাম। সেই পাচু। সেই আদর্শবান পাচু।

আমাকে পশ্চিমবঙ্গে থেকে ২০০৭ সালে বের করে দেওয়ার পর প্রতিবছর কিছু ছেলেমেয়ে ২২ নভেম্বর তারিখে লজ্জা দিবস উৎযাপন করে। প্রতিটি লজ্জা দিবসে পাচু রায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। তবে উদ্যোক্তারা একটা সময় তাঁকে আর ডেকেও পাননি । পাচুর তখন পচন শুরু হয়েছে। যখন থেকে তিনি মমতার দিকে ঝুঁকছিলেন, তখন থেকেই তিনি লজ্জা দিবসে অনুপস্থিত থাকছিলেন। যেহেতু মমতাকে মুসলিমমৌলবাদীতোষণের জন্য তসলিমাবিরোধী হতে হবে, তাই পাচু বুঝে যান লজ্জা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন জানলে মমতা অসন্তুষ্ট হবেন।

পাচু এরপর, যা শুনি, নির্লজ্জভাবে সরকারের সব অন্যায়, অত্যাচার, অসভ্যতাকে মেনে নিচ্ছেন, ওসবকে বরং অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে পত্রিকায়, টিভিতে প্রচার করছেন। না, এই পাচুকে আমি চিনি না। এই পাচু আমার বন্ধু নয়। মমতা পদলেহনকারীকে পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করেন না। পাচুকে তৃণমূলের টিকিট দিয়েছেন। নির্বাচনে শুনেছি জিতেছেন পাচু। বয়স তো সত্তর পার হয়েছে কয়েক বছর হলো। এ সময় বোকা না হলে নিজের সারাজীবনের অসামান্য সব আদর্শকে কেউ বিসর্জন দেয়! কিসের লোভে! কিছুর তো অভাব ছিল না পাচুর! যে পাচু সিপিএম সরকারকে তুলোধুনো করেছিলেন বই নিষিদ্ধ করেছিল বলে, মমতার সরকার পাচুর চোখের সামনে আমার মেগাসিরিয়াল নিষিদ্ধ করলো, বইমেলায় আমার নির্বাসন নামের বইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করলো, পশ্চিমবঙ্গে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ করলো, পাচু একটা টুঁ শব্দ করেনি। কেন? তাহলে কি সামান্য ওই ক্ষমতার লোভ! অতি সামান্য একটুখানি কিছু! একটা ছোটখাটো চেয়ার! যে নেত্রী ধর্ষিতাকে দোষ দেন ধর্ষণের জন্য, যে নেত্রী বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, কার্টুনিস্টদেরও জেলে ভরেন, যে নেত্রীর মদতে মুসলিম মৌলবাদীরা ফুলে ফেঁপে ভয়ংকর হচ্ছে, সেই নেত্রীর সামনে নতজানু পাচু, যে পাচুকে একসময় সত্যের এবং সততার প্রতীক বলে ভাবতাম!

এই ছবিটা পাচুর সঙ্গে কলকাতার শ্যামবাজারের মোড়ে, একটা ছোট রেস্টুরেন্টে খাচ্ছি। পাচু তখনও পাচু ছিল, তখনও পচেনি।



মন্তব্য চালু নেই