এক রোহিঙ্গা তরুণীর বাস্তুচ্যুত হওয়ার করুণ কাহিনী

২০১২ সালে রাখাইন রাজ্য জুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় ‘খিন মি তিওয়ানের’ বছর বয়স তখন ২২। ওই সময়ে তিনি কেবলই ‘সিতোই’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন এবং স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের জন্য ইয়াঙ্গুন যাবার পরিকল্পনা করছিল। কর্মজীবনে একজন কূটনীতিক হওয়ার তার অনেকদিনের স্বপ্ন তখন তাকে তাড়া করছিল।

তারপর এক রাতে তার শহর ‘সিতোইে’ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে তার স্বপ্নের পরিকল্পিত ভবিষ্যত হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। চোখের সামনে তিনি তার প্রতিবেশিদের ইস্পাতের লাঠি দিয়ে পেটানো এবং ছুরি দিয়ে আঘাতের দৃশ্য দেখেছেন। তিনি দেখেছেন, বর্বরদের নির্মম অত্যাচারে তার বাবা প্রায় মারা যাচ্ছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার বাবার মস্তিষ্ককে দেখতে পাই। আমি আমার বন্ধুদের ছুরির আঘাতে মারা যেতে দেখেছি। সেখানে ছিল সর্বত্র রক্ত আর রক্ত। ওই সময়ই আমি শেষবারের মতো আমার প্রতিবেশিদের দেখেছিলাম।’

মায়ানমারের প্রায় ১ মিলিয়ন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের একজন খিন মি। ২০১৫ সালে যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বৌদ্ধচরমপন্থীদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছোট নৌকায় সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ছিলেন; তখন তিনি আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হন। ওই সময় শরনার্থী হিসেবে কোনো দেশ তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ছিলেন।

২০১২ সালের বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনে খিন মিসহ প্রায় এক লাখ বিশ হাজার রোহিঙ্গা তাদের নিজ গৃহ থেকে পালিয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হওয়ার চার বছর পরেও মায়ানমার সীমান্তে সহিংসতার কোনো অবসান ঘটেনি।

দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গদের অধিকাংশই একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। অঞ্চলটিতে আবার রয়েছে কড়া পুলিশি পাহারা। সেখান থেকে বাইরে যেতে কিংবা বাড়িতে ফিরে আসার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।

ক্যাম্পের দেয়ালের ভিতরে তারা কাজ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, (—) ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তাদের অধিকাংশকেই বেঁচে থাকার জন্য দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়। সেখানে তরুণী ও নারীরা প্রায় (—) এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে।

খিন মি সীমাবদ্ধ ওই অঞ্চলে বসবাস সর্ম্পকিত আলোচনায় বলেন, ‘প্রথম প্রথম এটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগত। আমি এখানে ট্রাউজার্স পরতে পারতাম না। নারীরা চা স্টলে যেত না এবং সেখানে কোথাও বই ধার কিংবা কিনতে পাওয়া যেত না।’

তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে শেয়ার পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করা হতো। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসত এবং ল্যাট্রিন ছিল বাইরের দিকে। রাতে ল্যাট্রিন ব্যবহার করার সময় অনেক নারী ও কিশোরীদের (—) হয়রানির সম্মুখীন হওয়ার ভয় ছিল। যাইহোক, সেখানকার অধিকাংশ কুঁড়েঘরেই কোনো তালার ব্যবস্থা ছিল না এবং এমনকি অন্ধকারেও সেখানে সুরক্ষার কোনো গ্যারান্টি ছিল না।’

এমন অস্থায়ী কুঁড়েঘরে কোনো রকম গোপনীয়তা ছাড়াই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তারা বাস করতে বাধ্য হচ্ছে এবং এসব নিপীড়ন তাদের মধ্যে চরম হতাশার জন্ম দিচ্ছে যা দেশটিতে অভ্যন্তরীন সহিংসতার অন্যতম কারণ।

নিরাপদ স্থানের খোঁজে
স্থানচ্যুতির জবাবে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি এবং মেটা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউএনএফপিএ মায়ানমারের ১৫ জন তরুণী ও নারীকে নিয়ে ‘উইমেন এন্ড গার্লস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করে।

তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, নারী ও মেয়েশিশুদের সামাজিক সহায়তা প্রদান, (—-) ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য, পরিবার পরিকল্পনা, মনোসামাজিক কাউন্সিলিং, অন্যান্য সহিংসতা সংক্রান্ত সেবা এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালে নেয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা। কেবল ২০১৫ সালেই ১৬,০০০ নারী ও মেয়েশিশু ওই সেন্টার থেকে নিয়েছে।

এই সেন্টারের সকল কর্মী সেখানকার বাস্তুচ্যুত নারী ও মেয়েশিশু। সেখানে কাজের মাধ্যমে তারা আর্থিক নিরাপত্তা পাশাপাশি অর্জিত বাস্তব জ্ঞান ক্যাম্প জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে।

রাখাইনে ইউএনএফপিএ’র সাতটি কেন্দ্রে কর্মীদের একজন খিন মি। সেখানে তিনি একজন দায়িত্বশীল ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করছেন।

রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরুর আগে গত মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, আমার কাজ সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আসা অধিকাংশ নারীই অশিক্ষিত কিংবা সামান্য শিক্ষা আছে। আমরা তাদের শুধু লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে শেখাচ্ছি না, তাদের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সম্পর্কেও ধারণা দিচ্ছি।’

পরিতৃপ্তিদায়ক কাজ সত্ত্বেও তিনি কিশোরীদের মধ্যে ক্রমাগত আশা ও নৈরাশ্য দেখতে পান বলে তখন জানিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক আবারো রাখাইন রাজ্য সংখ্যালঘু হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর রক্তাক্ত নির্যাতনের অভিযোগ উঠে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাদের অমানবিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে এসব অসহায় রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শবর্তী বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শত শত রোহিঙ্গা গণ(—), ভয়ংকর নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে ওঠে আসছে।

সাম্প্রতিক নির্যাতনে প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে কয়েক হাজার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

গণ(—), নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ তদন্ত করতে বিদেশি সাংবাদিক, স্বাধীন তদন্ত সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের এসব অঞ্চলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে দেয়া হচ্ছে না।

কয়েক প্রজন্ম ধরে এসব রোহিঙ্গারা বার্মায় বসবাস করে আসছে। তারপরেও তাদের নাগরিকত্বকে স্বীকার করা হয়নি। তারা বিবাহ, ধর্মপালন, সন্তান জন্মদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগণ হিসাবে বসবাস করছে। -ইউএনএফপিএ’র অফিসিয়াল সাইট অবলম্বনে।



মন্তব্য চালু নেই