এক রিকশাচালকের গল্প

এই ভদ্রলোকের নাম নজরুল ইসলাম। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। পেশায় রিকশাচালক। ওনার দেশের বাড়ি দিনাজপুর। তাঁর ছবিসহ জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করার একটা কারণ আছে। কারণটা বলি। কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধ থেকে কাঁটাবনের রিকশাভাড়া ৫০ টাকা। হাতিরপুল বাজারে গেলে ৬০ টাকা। বেশি ভাড়া চায় কেউ কেউ; কিন্তু এর কম কাউকে চাইতে শুনি না সাম্প্রতিককালে।

কিন্তু এই নজরুল ইসলাম আমাকে অবাক করে আমার কাছে কাঁটাবনের ভাড়া চাইলেন ৩৫ টাকা। কেউ বড্ড বেশি ভাড়া চাইলে মাথা গরম হয়। আবার অভাবিতভাবে কোনো রিকশাওয়ালা যদি কম ভাড়া চেয়ে বসেন, তাহলেও দেহমনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে। আমারও তা-ই হলো। আমি রিকশাওয়ালার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, ঠিক আছে আমি আপনার রিকশায় উঠছি; কিন্তু ভাড়াটা কাঁটাবনে গিয়ে ঠিক করব।

কাঁটাবনে গিয়ে রিকশা থেকে নেমে আমি বললাম, আপনি সোজা হয়ে দাঁড়ান, আমি আপনার ছবি তুলব। মুখপঞ্জিতে আপনার সম্পর্কে লিখব। আমি পথের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে রিকশাওয়ালার ছবি তুলছি দেখে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। একজন বলল, ‘কবি দাদা ওর ছবি তুলছেন কেন? কী করেছে ও?’ আমি বললাম, ও মানুষ ভালা না।

রিকশাওয়ালা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘স্যার আপনে মুরব্বি মানুষ। কুনু অন্যায় হইলে আমারে মাফ কইরা দিয়েন। ততক্ষণে ছবি তোলা শেষ। আমি তাঁকে তাঁর সদ্য তোলা ছবিটা দেখালে তিনি খুশি হলেন। তাঁর মুখ থেকে ভয়ের ভাবটা কেটে গেল। বুঝলেন এত মমতা দিয়ে যে লোক তাঁর ছবি তুলেছেন, সে নিশ্চয়ই ভালো মানুষ। আমি ৫০ টাকার একটা চকচকে নোট তাঁর দিকে তুলে ধরে বললাম, যান আজকের মতো আপনাকে মাফ করে দিলাম। ভবিষ্যতে আর কখনো যদি কম ভাড়া চান, তো আপনার খবর আছে। মনে থাকবে?

টাকাটা বুক পকেটে রেখে রিকশাওয়ালা বললেন, ‘মনে থাকবে।’ যাওয়ার আগে তিনি বললেন, ‘স্যার আমার একটা ছেলে আছে, ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর জন্য দোয়া করবেন। ও জানি আপনের মতো কবি হয়।’ শুনে আমার চোখে জল এসে গেল।

[ কবি নির্মলেন্দু গুণ, কামরাঙ্গীরচর, ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ]



মন্তব্য চালু নেই