এক দুঃসাহসিক লাবণ্য হিজড়ার গল্প…

হিজড়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। যাত্রীদের জিম্মি করে অর্থ আদায় করেন, ছিনতাই করেন, শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা বাগিয়ে নেন-এমন আরও নানা অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। লাবণ্যর সাহস এসব ধারণায় চিড় ধরিয়েছে। তাঁর কাজে গর্বিত হিজড়া সমাজ। অনেকেই নতুন করে ভাবছেন হিজড়াদের নিয়ে।

লাবণ্য হিজড়ার গল্প এখন সবার জানা। ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়‌ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুরকে। ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় লাবণ্যই দুই হাত দিয়ে তাঁদের আটকান। তুলে দেন পুলিশের হাতে।

এ ঘটনা বেশ আলোচিত হয়। খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুজনকে ধরে পুলিশে দিয়েছেন একজন হিজড়া-কম সাহসের কথা নয়! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়।

সে সময়ের কথা সহজভাবেই বলেন লাবণ্য। বলেন, ‘খালি শুনি ধর, ধর। রাস্তায় জ্যাম। কিন্তু পাবলিক ধরে না। ১৫-২০ হাত দূরে পুলিশও দৌঁড়াইতেছে। আমি শাবাশ (সাহস) করে ধরলাম। পাশ দিয়া যাওনের সময় দুজনের পেছন দিক দিয়া গেঞ্জির মধ্যে ধরি। বাঁচনের লাইগ্যা আমার হাতে চার পাইচটা কিল মারে ওরা। একজনের হাতের ব্যাগ থেইক্যা তখন একটা চাপাতি রাস্তায় পইড়া গেল। আমি ভাবতে ছিলাম, ভয়ের কী আছে? একদিন না একদিন তো মরণ লাগবই।’

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ১৯৯৬ সাল থেকে হিজড়াসহ যৌন সংখ্যালঘুদের স্বাস্থ্য সেবা ও অধিকার আদায়ে কাজ করছে। এ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, ‘এত দিন ধরে কাজ করছি। বলতে গেলে লাবণ্য যে সাহস দেখিয়েছে ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, এর আগে হিজড়াদের পক্ষ থেকে কেউ তা করেনি। এতে আমাদেরও কাজের স্বীকৃতি মিলেছে। লাবণ্য বুঝে বা না বুঝে যে কাজটি করেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশ তএটাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে পারে। ভারতে হিজড়াদের ট্রাফিক সিগন্যালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও হিজড়াদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশ বাহিনীর কাজে লাগানো যেতে পারে।’

গত বছর হিজড়া প্রাইড উপলক্ষে ঢাকা ডিক্লারেশনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া, গণমাধ্যমে হিজড়াদের ভুলভাবে উপস্থাপন বন্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল। লাবণ্যর ঘটনার পর তা আবার আলোচনায় এসেছে। তখন ঢাকা ডিক্লারেশনের সুপারিশগুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। লাবণ্যর ঘটনা এই ডিক্লারেশনের দাবিগুলোকে আবার যৌক্তিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছে।

এই ঘটনায় লাবণ্যর পরিচিতি বেড়েছে। বেড়েছে শঙ্কাও। অন্য হিজড়ার সঙ্গে লাবণ্যও বাজারে বাজারে ঘুরে টাকা তোলেন। এটিই তাঁদের জীবিকা। তাঁদের ভয়, ওয়াশিকুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ যদি লাবণ্যকে চিনে ফেলে? তখন কে দেবে নিরাপত্তা?

গত সপ্তাহে কথা হয় লাবণ্য ও তাঁর ‘গুরুমা’ স্বপ্না হিজড়ার সঙ্গে। স্বপ্না বলেন, ‘লাবণ্য যে কাজ করেছে, তাতে আমরা গর্বিত। তবে একইসঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে? ’

পুলিশ প্রশাসন থেকে কেউ এখন পর্যন্ত লাবণ্যর খোঁজ করেনি বা কোনো ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করেনি বলে জানান লাবণ্যর ‘গুরুমা’ স্বপ্না।

লাবণ্যর বয়স এখন বিশের ঘরে। নয় বছর বয়সে অগ্রজ এক হিজড়ার সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান লাবণ্য। চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানে সাত বছর থাকার পর চলে আসেন ঢাকায়। লাবণ্য নিজের জীবনের কথা বলতে তেমন আগ্রহী নন। টুকটাক মাথা নেড়ে বা কম কথায় উত্তর দিয়ে চুপ করে যাচ্ছিলেন। তবে ওয়াশিকুরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত দুজনকে ধরার প্রসঙ্গ এলেই তাঁর চোখ চকচক করতে থাকে। লাবণ্য জানান, এই দুজন যে কাউকে খুন করে পালাচ্ছেন, ধরার আগে বিষয়টি তাঁর মাথায়ও খেলেনি। শুধু মনে হয়েছে, এঁরা কোনো খারাপ কাজ করেছেন, তাই ধরতে হবে।

এত বড় একটা কাজ করেও লাবণ্যের এ নিয়ে কোনো গর্ব নেই। চাওয়ারও নেই কিছু। তবে তিনি যে আলো দেখালেন, এতে হিজড়াদের নিয়ে নতুন কোনো পথ দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই