উন্মুক্ত হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম জাদুঘর

প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকেই লম্বা হাঁটার পথ চলে গেছে নিচের দিকে। বলা যায় পাতালে। কিছু দূর গিয়ে পথটি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটি কক্ষ, কক্ষের বাইরে লেখা ‘অডিও/ভিজ্যুয়াল রুম’। সেখানে চলছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সিনেমা ‘শ্যামল ছায়া’। কক্ষটি দর্শকে পরিপূর্ণ। কক্ষটি পার হয়ে এলে বিরাট জায়গাজুড়ে বিভিন্ন ছবি নিয়ে বিশাল প্রদর্শনী। ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছেন আগত দর্শকেরা।

ওপরে উল্লিখিত চিত্রটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত স্বাধীনতা জাদুঘরের। স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর আজ বৃহস্পতিবার থেকে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। খুলে দেওয়ার পর থেকে দর্শকেরা ভিড় করছেন সেখানে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দর্শক। স্বাধীনতা জাদুঘরটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার বাস্তব নিদর্শনে আরও সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৪৪টি প্যানেলে বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতিসত্তার স্বাধীনতার ইতিহাস আলোকচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।

আলোকচিত্রের মধ্যে রয়েছে মুঘল আমল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ের ছবি, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ছবি। আছে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এবং ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের বিশাল আকৃতির দুটি ছবি। এ ছাড়া যে টেবিলের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন তার অনুকৃতি (রেপ্লিকা)। বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কপি এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও পুস্তিকার ছবি।

প্রথম শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বুঝাতে জাদুঘরে ঘুরতে নিয়ে এসেছেন বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা কাজী সালেহ উদ্দিন আহমেদ। মেয়ে কাজী মাশফি আহমেদ বলল, ‘ভালো লাগছে। স্বাধীনতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছি।’ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছেলে নাজমুস সাকিবকে নিয়ে এসেছেন আনোয়ার ইসরাইল। তিনি বললেন, ‘পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানুক, দেশের ইতিহাস জানুক।’

স্বাধীনতা জাদুঘরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্থাপত্যশৈলী। পাতালে অবস্থিত জাদুঘরটির বিশাল এলাকা জুড়ে ফাঁকা জায়গা। পুরো জায়গা জুড়েই স্থানে স্থানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের ছবি। জাদুঘরের মাঝখানে রয়েছে একটি ফোয়ারা। ফোয়ারাটি নেমে এসেছে মাটির উপরিভাগ থেকে। জাদুঘরের স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী শাফিনাজ জাহান। তিনি বলেন, ‘স্থাপত্য অসাধারণ, অসম্ভব সুন্দর। তবে ছবিগুলো নির্দিষ্ট কোনো সিকোয়েন্সে সাজালে মানুষের ইতিহাসটা বুঝতে সুবিধা হতো।’

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা জাদুঘর পরিচালিত হবে। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে গণপূর্ত বিভাগ। স্বাধীনতা সংগ্রাম জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ এহসানুল হক জানান, আজকের জন্য সবার প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত। জাদুঘরটি প্রতি শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বুধবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ১০ টাকা এবং ১২ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশমূল্য দুই টাকা। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিনে জাদুঘরটি বন্ধ থাকবে।

৬৭ একর বিস্তৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার পাকা চাতাল বা প্লাজা এবং এর চারপাশে রয়েছে তিনটি জলাশয়, বাঙালি জাতিসত্তার অমরতার প্রতীক ‘শিখা চিরন্তনী’ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভিত্তি করে নির্মিত একটি দেয়ালচিত্র। জাদুঘরের উপরিভাগে রয়েছে ১৫৫ আসনসংখ্যার আধুনিক মানের মিলনায়তন। স্বাধীনতা স্তম্ভটি বস্তুত ১৫০ ফুট উচ্চ একটি গ্লাস টাওয়ার। গ্লাস টাওয়ারে স্থাপিত লাইটের আলোকরশ্মি পাঁচ কিলোমিটার উঁচুতে প্রক্ষেপিত হয়।



মন্তব্য চালু নেই