দূরদেশে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুকে ফিরে পাবার কাহিনী
ইরামার গল্পটি এখানেই শেষ হয়নি
ফেসবুকে চোখ বুলাতে গিয়ে হঠাৎ ডিসেম্বর ০৪, ২০১৪ তারিখে লেখা লেখাটি চোখে পড়ল। পাবলিকলি একসেস দেয়ায় সবাই লেখাটি পড়তে পারবে। এটি এক বাবার লেখা যার শিশু সন্তানটি টার্কিশ এয়ারলাইন্স এর অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার কারনে বাংলাদেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে তুরস্কের বিমানবন্দরে হারিয়ে গিয়েছিল। মাত্র ছয় বছরের সেই শিশু সন্তানকে ফিরে পেতে বাংলাদেশ থেকে তার বাবার বিনিদ্র রজনীর উদ্বিগ্নতা ও প্রচেষ্টা এই লেখাতে ফুটে উঠেছে। লেখাটি সবার পড়া দরকার। আপনার পরিবারের কারো এমন বিপদ ঘটলে কি করবেন বা কিভাবে কোথায় সহযোগীতা পাবেন তার দিকনির্দেশনা পাবেন এই লেখায়। পাঠকদের সচেতনতার জন্য লেখাটি আমরা প্রকাশ করলাম। লেখাটি এখান থেকে প্রাপ্ত এবং লিখেছেন দৈনিক কালের কন্ঠের ইভেন্ট এডিটর জনাব সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন।
না। ইরামার ওয়াশিংটনে মায়ের কাছে যাওয়ার গল্পটি শেষ হয়নি।
এটাকেই বোধহয় কাইমেক্স বলে।
২৮ নভেম্বর সকাল ৭টায় ইরামাকে নিয়ে টার্কিস এয়ারের ফাইটটি যখন চোখের সামনে আস্তে আস্তে আকাশে মিলিয়ে গেল তখন থেকে আরো সাত ঘণ্টা পরে ইস্তাম্বুল কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দরে কি ভয়াবহ বিপদ অপোক্ষায় আছে আমার ছোট্ট মেয়েটির জন্য তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। অনেক দিন পর মায়ের সঙ্গে দেখা করার যে অপার আনন্দ দেখেছি তার চোখে-মুখে সেই আনন্দের এত বেদনাদায়ক পরিণতি হবে; বুঝতে পারিনি।
খুবই চুপিসারে ২৯ তারিখ রাত ৩টায় (২৮ তারিখ দিবাগত রাতে) বিপদটি আসলো।
একটি মিসকল। বিদেশি নম্বর।
ইরামার ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন যাত্রার দীর্ঘ পথটি অনুসরণ করছিলাম লাইভ ফাইট রাডারে।
কে ফোন করতে পারে এত রাতে? চোখে রাজ্যের কান্তি আর গভীর বিষাদ।
বেশ বিরক্তি নিয়েই কল ব্যক করতেই ওপাশ থেকে বিজাতীয় ভাষায় কিছু কথা শুনে মেজাজটা খিচড়ে গেল। এরপরই আতঙ্কে হীম হয়ে গেলাম আমার মেয়ের অসহায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা তুমি এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাও। এরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে; আমি আর আমেরিকা যাব না।’
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এ সময়ে তো ওর ফোন করার কথা না। প্লেনে থাকার কথা; আটলান্টিকের ওপরে গ্রিনল্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য একদম ব্লাকআউট। প্রচণ্ড ভয় আমার সমস্ত বিচার-বুদ্ধি গ্রাস করে নিচ্ছে। হাওয়ার বেলুনের মতো আমি দিকভ্রান্ত। ভারসাম্য হারিয়ে হাওয়ায় ভাসছি।
এরপরে ইরামার নানিরও কান্নাজড়িত ভয়ার্ত কণ্ঠ…
তারও একই কথা… আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাও।
বললাম শান্ত হন। কী হয়েছে?
ফোনটি ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের এক ফল দোকানির। এক মিনিটেই খুবই দ্রুততায় সে যা বলল তা শুনে আমার অন্তরাত্না কেঁপে উঠল…
জানতে পারলাম টার্কিস এয়ারের ঢাকা টু ইস্তাম্বুল ফ্লাইটি এক ঘণ্টা দেরির কারণে ইস্তাম্বুল থেকে ওয়াশিংটনগামী কানেকটিং ফ্লাইটটি তাদের রেখেই উড়ে গেছে ওয়াশিংটনের পথে।
টিকিটে শিশু ও বৃদ্ধা ক্যাটাগরিতে তাদের হুইল চেয়ার ও অ্যাটেনডেন্ট দেওয়ার কথা থাকলে ইস্তাম্বুলে টার্কিস এয়ারের লোকজন তা দেয়নি। হোটেল দেওয়ার কথা থাকলেও অ্যাটেনডেন্ট না পাওয়ায় তারা নিজ উদ্যোগে কয়েক শ মানুষকে কখনো ইংরেজিতে বলে, কখনো হাতে লিখে এবং কখনো আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিতে সক্ষম হলেও তাদের হোটেল দেওয়া হয়নি।
যেহেতু অফবোর্ড প্যাসেঞ্জার, তাও আবার বাংলাদেশের। টার্কিস এয়ারের কাছে এসব প্যাসেঞ্জারদের দামও কম। টার্কিস এয়ার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। নিজের চেষ্টায় এয়ারপোর্টের বাইরের হোটেল নিতে গিয়ে প্রতারকের পাল্লায় পরে ভয়ে আতঙ্কে সেখান থেকে পালিয়ে এসে এক ফলের দোকানের পাশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। জানলাম; ভয়ে আতঙ্কে ইরামার ডিসেন্ট্রি হয়ে গেছে। দু-তিনবার প্যান্টে পায়খানা করে দিয়েছে সে।
বাইরের খাবার খুব কমই খায় আমার মেয়ে। বিজাতীয় খাবার না খেয়ে, ক্ষুধা ভয় আর শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে নিস্তেজ হয়ে পরে আছে ঢাকা থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের এক অচেনা বিমানবন্দরে। ভয়ে হিস্ট্রেরিয়াহয়ে গেছে ওদের। কত মানুষকেই একটু সাহিয্যের জন্য অনুরোধ করেছে; কেউ-ই সাহায্য করেনি। সাহায্য করেনি টার্কিস এয়ার। সাহায্য করেনি টার্কিস ইমিগ্রেশন পুলিশ ইংরেজিভাষা না ভালো বোঝার কারণে।
অদ্ভুত শীতল ভয়ের শিহরণে আমি হারিয়ে ফেললাম নিজেকে। মাথা একদম ফাঁকা। অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলতে দুলতে অচেনা দুশ্চিন্তা একটাই। যদি কোনোক্রমে এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়ে যায় ওরা তা হলে কীহবে! কী করে আবার খুঁজে পাব ওদের?
আটলান্টিকের ওপারে তখন সূর্য ডুবছে সবে। হিম ঠাণ্ডা হাড় কাঁপানো বাতাস আর ভেজা তুলার মতো তুষারে ঢেকে যাওয়া রাজপথে ঘর ফিরতি মানুষের ভিড়ে ইরামার মা দিশেহারা হয়ে ছুটছে উল্টোপথে ওয়াশিংটনের ডুলেস বিমানবন্দরের দিকে। খবরটি সেও পেয়েছে ইস্তাম্বুল থেকে ওয়াশিংটনের পথে ছেড়েআশা টিকে ০০৭ বিমানটির যাত্রী তালিকায় ওদের নাম না দেখে।
ফোন করা শুরু করলাম। প্রথমে ঢাকাতারপর ইস্তাম্বুল…
শতবার ফোন করেও কাজ হলোনা টার্কিস এয়ারে। না ঢাকায়, না ইস্তাম্বুলে। শেষ পর্যন্ত ওদের প্রধান কার্যালয়ে ফোন করলাম। সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ বার। কোনো লাভ হলো না। বিজাতীয় ভাষায় কিছু কিচিরমিচির আর চড়া কল রেটে মোবাইল ব্যালেন্স নিঃশেষ হওয়া ছাড়া ফলাফল শূন্য। ফোন করলাম ওদের ২৪ ঘণ্টা কল সেন্টারে । ওয়াল্টার নামে এক বদমাস ধরল ফোন। সে জানালো আমার একসেন্ট সে বুঝছে না। বিরক্তি নিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে পরামর্শ দিল টার্কিস ভাষা জানে এ রকম কাউকে খুঁজে আনতে, সে এখন জরুরি বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত আছে।
আবার ফোন দিলাম। ধরল আন্দ্রিয়া নামে এক মেয়ে। অনেক খুঁজে কম্পিউটার ঘেঁটে সে জানালো আমার মেয়ের নাকি আইটেনারিপ্রবলেম হয়েছে। পরামর্শ দিল আমি যেন ইরামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শতবার বলার পরও আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না যে ইরামা তার এয়ারপোর্টে মিসিং। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। তার জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। ফোন কেটে দিল। দিশেহারা হয়ে আরো প্রায় ১৫-১৬বার ফোন দিলাম ওদের কল সেন্টারে। প্রতিবারে নানা হাত ঘুরে কল যাচ্ছে ওয়াল্টারের কাছে। আর অত্যন্ত কুৎসিত ভাঙা ইংরেজিতে সেই বদ-লোকটির ওই একই কথা ‘আমার একসেন্টবুঝতে পারছে না। একপর্যায়ে আমি যেই রেগে যেয়ে ওদের গাফিলতির কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিলাম তখন ও সবই ঠিকমতো বুঝল। টার্কিস ভাষায় কি জানি বলে লাইনটি কেটে দিল।
ওয়েবসাইটে টার্কিস এয়ারের বিজনেস পলিসিতে বাচ্চা, ও বয়স্কদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা। তারা এ বিষয়ে আমাকে কোনোই সহায়তা করল না।
ফোন দিলাম আবার সেই ফল দোকানিকে।সে ফোন কেটে দিচ্ছে বারবার।
আরো সন্দেহ দানা বাঁধল। এই লোকটাও যদি প্রতারক হয়; সে যদি সাহিয্য বা মিথ্যা বলে ওদের এয়ারপোর্টের বাইরে নিয়ে যায়।সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
কিন্তু লোকটা ফোন কেটে দিচ্ছে কেন বারবার? সন্দেহ আর অজানা আশঙ্কায় আমার গলা শুকিয়ে আসছে।
বন্ধু-বান্ধবের কাছে টার্কিসএয়ারের বদনাম ইতিমধ্যে শোনা থেকে মুখস্থ হয়ে গেছে। মান্ধাতা আমলের টার্কিস এয়ার হটাৎ করেই ব্যবসা বর্ধিত করে আর বেশ কিছু পুরনো কর্মচারীদের প্রধান কার্যালয়ে পুনর্বাসন করে এক হুলস্থুল হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে পড়েছে সংস্থাটি।
ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের ফাইট মিস করিয়ে অন অ্যারাইভেল ভিসা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এরপর হোটেলের ব্যবস্থা না করায় এয়ারপোর্টের বাইরে যাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল নাকি নিত্যনৈমিত্তিক। এ অবস্থায় একটি ছয়বছরের মেয়ে আর ৬৮ বছরের এক বৃদ্ধ মহিলা কিই বা করতে পারবে?
ঘন কুয়াশা ঘেরা ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে তখন প্রায় শেষ রাত। আমি এখনো জানি না ইরামা ওই এয়ারপোর্টের কোথায়। কেমন আছে ।
ফোনে কথা বলার সময় শেষে ইরামার নানিকে বলছিলাম, ‘আমার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সে যেন কোথাও না যায় কিংবা কোথাও না নড়ে। সেটাই এখন একমাত্র ভরসা। আর ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। কী করব? আমি একদম দিশেহারা।
লাস্ট থ্রি ডে’স সিনেমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিমানবন্দরের লে-আউট নিয়ে বসলাম। ধারণা করার চেষ্টা করছিলাম ওদের অবস্থান।
অত বড় একটি বিমানবন্দরে ছোট একটা ফলের দোকান কিভাবে খুঁজে পাব?
ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হচ্ছে আমারও শারীরিক শক্তি। হারাতে বসেছি আমারও বিচারবুদ্ধিও।
বেপরোয়া হয়ে উঠছি আমি। একদম দিশেহারা হয়েই ভোর ৫টার দিকে বিস্তারিত জানিয়ে ই-মেইল দিলাম ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। বুদ্ধি করে ইরামার শাহাজালালে তোলা একটি ছবিও দিয়েছিলাম ওদের। জানা ছিলএই বিমানবন্দরটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বিখ্যাত জার্মানি প্রতিষ্ঠান টাভ এয়ারপোর্ট। ওটাও একটা ভরসা।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মেইলের রিপ্লাই এলো। আমাকে আশ্বস্ত করে লেখা মেইলটির সিসি দেওয়া হয়েছে এয়ারপোর্টে কর্মরত সব সংস্থাকে। জানালো আমার মেয়ের ছবি নিয়ে কয়েক শ লোক তল্লাশি চালাচ্ছে এয়ারপোর্টের প্রতিটি অলিগলিতে। বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য। ৩ থেকে ১০ বছরের বাচ্চা নিয়ে কোনো যাত্রী বিমানবন্দরে ঢুকতেও পারছে না, বেরোতেও না। মেইলের ধরনটা দেখেই বুঝছিলাম হুলস্থুল অবস্থা ওখানে।
কিছুটা আশ্বস্ত হলেও ভয় আর যাচ্ছেনা। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে অপোক্ষায় আছি কী হয়; কী খবর আসে। বারবার ফোন দিচ্ছি সেই ফলদোকানিকে। লাইন কেটে দিচ্ছে সে বারবার। জানি না কী আছে অপোক্ষায়। ফোন আর আসে না।
একই সময়ে ওয়াশিংটন ডিসি ডুলাস এয়ারপোর্টে বসে আমার টেনশন আর ভয়কে আরো উসকে দিচ্ছে ইরামার মা। পৃথিবীতে এ রকমঅসহায় অবস্থায় আর পড়িনি। কী করব?
তাকেও আশ্বস্ত করলাম বিমানবন্দরকর্তৃপরে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে। বললাম যদি তারা ইরামাদের খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়সে যেন পরের প্রথম ফ্লাইট ধরে ইস্তাম্বুল পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। তেহরান থেকেএক আত্মিয়কে খবর দেওয়া হল সে যেন প্রস্তুত থাকে ইস্তাম্বুল আসার জন্য। তেহরান থেকে ইস্তাম্বুল এক ঘণ্টার ফ্লাইট।
আমার স্কুলের এক বড় ভাই দোহায় একটি এয়ারলাইনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকেও জানালাম বিষয়টি ।
মেইল আর আসে না। প্রতিটি সেকেন্ড যেন কয়েক হাজার ঘণ্টা। অপোক্ষায় আছি ঢাকায় টার্কিস এয়ারের অফিস খোলার। অপোক্ষায় আছি তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলার।
প্রলম্বিত সময়ে হাজার হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমন আছে ইরামা? মায়ের কাছে যাবে বলে দুই দিন ধরে যে আনন্দ দেখেছি তার চোখেমুখে; বারবার সেই আনন্দময় মুখটির করুণ পরিণতি চিন্তা করতে করতে আমার পৃথিবী দুলছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি আর পারছি না। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম বা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।কিছুই মনে নেই।
২৯ তারিখ সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে সম্বিত ফিরল একটি ফোনের আওয়াজে।
অনুর উলকার নামে টাভ এয়ারপোর্টের ইস্তাম্বুল শাখার এক কর্মকর্তা আমার নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ারপর জানালেন।
আমরা তোমার মেয়েকে খুঁজে পেয়েছি।সে এখন ভালো আছে।
বললেন, আমাদের বিমানবন্দরটিপৃথিবীর একটি নিরাপদ বিমানবন্দর হিসেবে গত বছর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ রকম একটি বিমানবন্দরে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন।
খুবই বিনয়ের সঙ্গে তিনি আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন।
যেহেতু বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম আমার কারণে বিঘ্নিত হয়েছে; দাপ্তরিক কারণেই তার কিছু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আনন্দের কান্নায় চোখের পানি আর নাকের পানি এক হয়ে গেছে আমার।
বললাম আমি আমার মেয়ের সঙ্গে আগে কথা বলতে চাই তারপর না হয় অনন্তকাল কথা বলব।
অবশ্যই অবশ্যই বলতে বলতে লাইনটি ট্রান্সফার করার সময় সে বলল তোমার অবস্থা আমি বুঝেছি। আমিও এক কন্যা সন্তানের বাবা। তুমি তোমার মেয়ের সঙ্গে আগে কথা বলো।
এবার ফোন ধরলেন এক ভদ্র মহিলা।দীর্ঘ দাপ্তরিক ফর্মালিটির কথাবার্তা শেষে…
আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এলো। সবশুনলাম ওদের কাছে। কী কী হয়েছিল সব।
ইরামাকে বললাম, ‘মা তোমার কোনো ভয় নেই। বাবা আছে না?’ মেয়ের ভয়ক্লিষ্ট আধো আধো ভাঙা ভাঙা কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন কয়েক শ আলোকবর্ষ দূর থেকে কথা বলছে সে।
চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরলেও ওকে বুঝতে দেইনি। কিন্তু সে ঠিকই বুঝেছে। বলল, বাবা তুমি কাঁদছো কেন। এখন তো আর ভয়নেই। তুমি আছ না।’
ওদের সব বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে গেলামআবার সেই ভদ্র মহিলার কাছে। তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ওদের জন্য সহযোগিতা নিশ্চিত করে আবার ফোনে ফিরে গেলাম অনুর উলকারের কাছে।
উলকার জানালেন তোমার মেয়েকে টার্কিস এয়ারের স্টেশন ম্যানেজারের জিম্মায় তুলে দেওয়া হয়েছে। আর কোনো ভয় নেই।
টার্কিস এয়ারের কার্যপ্রণালী এতক্ষণে আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। তিনি আরো জানালেন, ইস্তাম্বুল থেকে ওয়াশিংটনগামী এর পরের ফ্লাইট হচ্ছে ২৯ তারিখ বেলা দেড়টায়। মানে বাংলাদেশ সময় ২৯ তারিখ সন্ধ্যা ৫টা ৩০মিনিট। মানে তাদের আরো প্রায় ১২ ঘণ্টা ওখানে থাকতে হবে।
ভালো লাগছিল না আমার মেয়ে আবার টার্কিস এয়ারের তত্ত্বাবধানে থাকুক। সেটা তাকে খোলামেলাই বললাম। সে আবারও আমাকে আশ্বস্ত করল।
আবার টানা ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা।
ওদের দ্বিতীয় যাত্রাটা সুগম ও নিশ্চিত করতে ঢাকায় টার্কিস এয়ারের অফিসে ফোন দিলাম ২৯ তারিখ সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে।এদের অবস্থাও দেখলাম একই রকম। সব শুনে ওদের রিসিপশনের মেয়েটি বলল ‘আজ আমাদের অফিসে উচ্চপদস্থ কেউ নেই। আপনি বরং আগামীকাল সকালে একবার ফোন করে দেখুন।’
রাগে ক্ষোভে আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। আমার খুবই স্বল্প সময়ের পরিচিত এক বন্ধু আছে। এইমাত্র কয়েক দিন আগেই তারসঙ্গে আমার পরিচয়। ঝামেলার প্রথম থেকেই সে বিষয়টি জানত। ইরামাকে সে দেখেনি কোনোদিন। কিন্তু ইরামার জন্য তার উদ্বিগ্নতা, উৎকণ্ঠা আমাকে স্পর্শ করেছিল। তার একটা কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিপদটি শুনে সে বলেছিল, এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে তোমার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
আর কথা বাড়ালাম না। ভাবলাম আর কাউকে না পাই ওদের তো পাওয়াযাবে। ব্যবস্থাটা পরে করা যাবে। আগে আমার মেয়ে সুস্থভাবে ওয়াশিংটন পৌঁছাক।
বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায় আবার গভীর আতঙ্ক নিয়ে ফোন দিল ইরামার মা ওয়াশিংটন থেকে।
জানালো যে ফাইটটিতে অর্থাৎটিকে০০৭ ফ্লাইটটিতে ইরামার যাবার কথা সেই ফ্লাইটটির প্যাসেঞ্জার তালিকায় ইরামার নাম নেই।
ভয় আর আতঙ্কের শেষ প্রান্তে যেয়ে আমি তখন একনির্বোধ জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছি।
আবার ই-মেইল আবার ফোনকল আবার দৌড়াদৌড়ি। প্লেন ছাড়তে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি।
ইস্তাম্বুলে দুপুরের এই সময়টায় এয়ারপোর্টটি খুবই ব্যস্ত থাকে। কী হবে? কী হবে? এটা ভাবতে ভাবতেই যেন হটাৎ করেই এলো বন্ধুপ্রতিম এক ছোট ভাইয়ের ফোন। শিবলি ওর ডাক নাম। রক্তের আত্মীয়ের বাইরেও কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে, যা রক্তের আত্মীয়ের চেয়ে অনেক অনেক বড়। শিবলী-ই তার প্রমাণ। সবশুনে সে জানালো তার এক ব্যবসায়িক বন্ধু আছে ইস্তাম্বুলে। সে আমার ফোন রেখেই তাকে ফোনে সব বুঝিয়ে বলল। তার সেই টার্কিস বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছে বিমানবন্দরের পথে। তার মোবাইলে ইরামার সব তথ্যাদি পাঠালাম। সে বিমানবন্দরে গিয়ে ৩০মিনিটের মধ্যেই জানালো ইরামারা প্লেনে উঠে গেছে। প্লেন টেকঅফের অপোক্ষায়।
মনে আনন্দ এলেও ইরামার এই যাত্রার বাধাবিঘ্ন নিয়ে এতই টানটান উত্তেজনায় ছিলাম; আমার আর স্বস্তি আসছিল না। আবার ৯ঘণ্টার অপোক্ষা।
ইরামা আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে আর আমি লাইভ রাডারে ওকে অনুসরণ করছি। জানি না আবার কোন নতুন বিপদ অপেক্ষায়। অফবোর্ড প্যাসেঞ্জারদের ব্যাপারে আমেরিকান ইমিগ্রেশনের একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে।
এত দাম দিয়ে টিকিট কেটে টার্কিস এয়ারের সীমাহীন গাফিলতিতে আমি আমার মেয়েকে হারাতে বসেছিলাম প্রায়। ইস্তাম্বুলে সে যে সীমাহীন কষ্ট পেয়েছে এটা যতবার ভাবনায় আসছে আমি শিহরিত হয়েছি। এতবড় একটি ঘটনায় টার্কিসের ঢাকা ও ইস্তাম্বুল কর্তৃপক্ষের নিরুদ্বেগ, উদাসীনতা এবং গুরুতর গাফিলতি দেখে আমি হতভম্ব।
বাজেট এয়ারলাইনস হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও টার্কিস এয়ারের আসল উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই ওদের কানেকটিং ফ্লাইট মিস হচ্ছিল। ফলে ট্রানজিট যাত্রীদের বাধ্য হয়েই অন অ্যারাইভালভিসা নিতে হচ্ছে। কিছু ডলার খসে যাচ্ছে যাত্রীদের পকেট থেকে। আর হোটেলও পাওয়া যাচ্ছে না সব সময়।
আমার মেয়ে ইরামা নূরতাজ বয়স ছয় বছর পাঁচ মাস। মাত্র ১৮ ঘণ্টায় আমেরিকা পৌঁছানোর কথা থাকলেও দুই দিন ১৩ ঘণ্টা পর,জীবনের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি খুইয়ে, রাজ্যের কান্তি আর অবসাদ নিয়ে ৩০ তারিখ সকাল ৬টা ২৫ মিনিটে ওয়াশিংটনে পৌঁছায়। ওখানে যে হৃদয়বিদারক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা আমি সাতসমুদ্র তের নদীর এপারে বসেও অনুভব করেছিলাম।
আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে আমি কিছু মানুষকে পেয়েছি, যাদের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না কোনোদিন। আমি গর্বিত তারা আমার বন্ধু। কখনো কখনো রক্তের সম্পর্ককে ছাড়িয়ে অন্য কোনো সম্পর্ক বড় হতে পারে; তারাই এর প্রমাণ।
এই তো মাত্র অল্প কয়েক দিনের পরিচিত বন্ধুটি। ইরামাকে দেখেনি কোনোদিন। আমার বিপদে সে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক রকমযুদ্ধই করেছে। প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন যতগুলো সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছে ইরামাকে খুঁজে পাওয়ার, সবই আমার সঙ্গে শেয়ার করেছে। প্রেরণা আর সাহস জুগিয়েছে। দূরে থেকেও আমি যাতে ভেঙে না পরি, রেগে না যাই নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করেছে। এক ধরনের ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ইরামার উদ্ধার অভিযানটি। নেতৃত্ব দিয়েছে সে।
বন্ধুপ্রতিম শিবলী। ত্বরিতগতিতে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে তুরস্কের নাগরিক ইজমাইল শাকির নামে এক ব্যবসায়ীকে পাঠিয়ে ইরামার চূড়ান্ত গন্তব্যের খবর নিশ্চিত করেছে।যেটা ছিল সে সময়ে এক বিশাল অর্জন। দোহা আমার স্কুলের সিনিয়র এক বড় ভাই যিনি বিখ্যাত একটি এয়ারলাইনে কাজ করছেন। দোহা থেকে ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে তার প্রতিষ্ঠানের গ্রাউন্ড স্টাফদের মাধ্যমে খবর করেছেন ইরামার।
বন্ধু লিটন। আশ্বাস দিয়েছে সাহস জুগিয়েছে।
আর ছায়ার মতো লেগে থাকা আমার সার্বক্ষণিক তিন সহচর আকাশ, শিমুল ও জামান।
পাঁচটি ফোন এবং এগুলোর চার্জার নিয়ে সার্বক্ষণিক আমার পাশে বসে থাকা। রাত ৪টায় ব্যালেন্স রিচার্জ করা। বাসায় দ্রুত একটা মিনি কল সেন্টার স্থাপন। দেয়ালে বড় করে ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের লেআউট বসানো। একটার পর একটা ফোনের চার্জ শেষ, দ্রুতই পরের ফোনটা এগিয়ে দেওয়া, মোবাইলে চার্জ দেওয়া। মোবাইলে ব্যালেন্স শেষ; সেই ভোর রাতে রংপুর কিশোরগঞ্জ থেকে মোবাইল রিচার্জ করা; কত কিছুই না করেছে তারা।
আর সেই অচেনা বিদেশী বন্ধু টাভ ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা অনুর উলকার। বিভূয়ের সেই অচেনা মানুষটি সূদুর মারমারা সাগরের পারে বসেও একজন অসহায় বাবার আকুতি হ্রিদয় দিয়ে অনুভব করছিলেন।
এই আড়াই দিনে আমি ফোনে কথাবলেছিলাম সর্বসাকুল্যে ৩১ ঘণ্টা। টাকার হিসেবে সেটা ১৮ হাজারের মতো। কখনোইস্তাম্বুল কখনো দোহা কখনো ওয়াশিংটন কখনো ইতালি কখনো বা গ্রিস।
৩০ তারিখ সকালে গভীর ক্লান্তি নিয়ে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন আমার বয়স বেড়ে গেছে আরও ২০ বছর।
সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন
[email protected]
মন্তব্য চালু নেই