ইউরোপকে কি বাঁচানো সম্ভব?
১৯৫৭ সালের ২৫শে মার্চ। নতুন ধরনের এক আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল ইউরোপের ছয়টি দেশ। তখনও তাদের ওপর ২য় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া। পরবর্তীতে ওই জোট নাম পায় ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’। জোটটি এমন পর্যায়ে সফলতা অর্জন করেছে যা এর প্রতিষ্ঠাতাদের কল্পনাতেও আসেনি।
মহাদেশটিতে শুধু শান্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা নয়, এই জোট অভিন্ন বাজার তৈরি করেছে। চালু করেছে অভিন্ন মুদ্রা। দক্ষিণের প্রাক্তন-স্বৈরতন্ত্রের দেশগুলো থেকে শুরু করে পূর্বের সাবেক-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের জোটে এনেছে। ৬ দেশ থেকে বিস্তৃতি লাভ করে সদস্য সংখ্যা হয়েছে ২৮। তারপরও আজকের ইউরোপ নেতারা সপ্তাহান্তে যখন জোটের ৬০তম বর্ষপূর্তি উদযাপনে রোমে মিলিত হবেন, তারা জানেন যে তাদের প্রকল্প বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে।
অভ্যন্তরীন, বাহ্যিক দু’ধরনের হুমকিই রয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে, ইউরো সঙ্কটে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠা ত্রুটিগুলো এখনও সংশোধন করা বাকি। দীর্ঘায়িত অর্থনৈতিক কষ্ট ইইউ’র প্রতি সমর্থন কমে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে। জনতোষণবাদী, ইউরোপ বিরোধী দলগুলো ইইউ’র অস্তিত্বকেই আক্রমণ করছে। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রচারণায় ভালো করছেন ম্যারিন ল্য পেন। মে মাসের ভোটে ন্যাশনাল ফ্রন্টের এই নেতার জয় অসম্ভাব্য হলেও তার পালে জোয়ার অস্বস্তির কারণ।
এখন পর্যন্ত ইইউবিরোধী প্রতিক্রিয়ার সব থেকে নাটকীয় ফল হলো ব্রেক্সিট। জন্মদিনের আয়োজনে রোমে থাকবেন না বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ২৯শে মে ইইউ চুক্তির ৫০ অনুচ্ছেদ সক্রিয় করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এর পরের দু’বছর বৃটেনের প্রস্থান নিয়ে সমঝোতায় ব্যাপক সময় ও শক্তি ব্যয় হবে। এছাড়া, এতো বড় একটি সদস্য হারানো, ইইউ’র প্রভাব ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর বিরাট একটি ধাক্কাও বটে।
বাহ্যিক চাপগুলোও একই রকম গুরুতর। শরণার্থী সঙ্কট প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে মূলত ভূমিকা রেখেছে তুরস্কের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ এক চুক্তি। ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে নতুনভাবে আক্রমণাত্মক রাশিয়া আর নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইইউ ও ন্যাটো দু’টো নিয়েই নিরুৎসাহী। ফলে দুর্বল আর বিভক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপের জন্য খুব বাজে একটা সময় এখন।
তিক্ত পরিহাসের বিষয় হলো- যে প্রকল্পটি ইউরোপের যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তার ভিত্তি জোরালো করতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা এমন সময় দুর্বল হতে চলেছে যখন কিনা ওই নিরাপত্তাই হুমকির মুখে। একই সঙ্গে এ পরিস্থিতি এটাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইউরোপ যদি নিজেদের ঠিক করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কত কিছু হুমকির মুখে পড়বে।
এমন চ্যালেঞ্জের মুখে ইইউ-পন্থিদের
চিরাচরিত প্রতিক্রিয়া হলো- আরও ঘনিষ্ঠ জোটের দিকে সাহসী পদক্ষেপের জন্য পীড়াপীড়ি করা। তাদের যুক্তি, ইউরোকে সফল হতে হলে এটা তাদের প্রয়োজন। তারা এও বলেন যে, ইইউকে বাইরের দিকের সীমান্ত জোরদার করার সুযোগ করে দিতে ক্ষমতার বেশির ভাগ কেন্দ্রের দিকে সরাতে হবে আর নিশ্চিত করতে হবে এটা একক জোরালো কণ্ঠে কথা বলছে; মি. পুতিন আর মি. ট্রাম্পের মতো। তবে, তথ্যপ্রমাণ বলে, ইউরোপীয় ভোটাররা বা তাদের নির্বাচিত সরকাররা কেউই এটা চায় না। বরং জনমত এর উল্টোটারই পক্ষে।
আরও ঘনিষ্ঠ জোট যদি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে ব্রাসেলসের আরেকটি ঐতিহ্য হলো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েই সামলে নেয়া। ইউরো সঙ্কট সবথেকে বাজে পরিস্থিতি অতিক্রম করেছে। অভিবাসন বেড়েছে। আর ব্রেক্সিটও কোনভাবে সামলে নেয়া হবে। এই বছরের নির্বাচনগুলোর পর যদি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রন হন, আর পাশপাশি জার্মানির চ্যান্সেলর যদি অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বা মার্টিন শুলটজ হন- তাহলে জোটটি একনিষ্ঠ ইইউ-পন্থি নেতৃত্বের অধীনে থাকবে। তারপরও প্রতিবন্ধকার মধ্য নিয়ে সামলে নেয়ার পথে ঝুঁকি থেকেই যায়। নতুন করে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে যা ফের ইউরোর মান কমিয়ে দেবে বা, আরেকটি সরকারের নির্বাচন হতে পারে যারা ইইউ বা ইউরো সদস্যপদ প্রশ্নে গণভোট দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমন কোনো পরিস্থিতির অবতারণা হলে তা এই জোটকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে।
এর থেকে উত্তম বিকল্প কিছু কি আছে? এর উত্তর হলো: যেমনটা এই বিশেষ রিপোর্টে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে- বর্তমানের চেয়ে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউকে অধিকতর নমনীয় বানানোর চেষ্টা করা। ইউরোর ভাষায় এর অর্থ হলো একটি বহুস্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থা (মাল্টি-টায়ার) গ্রহণ করা যেখানে অধিকতর বিস্তৃত ইউরোপের দেশগুলো জোটের নীতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে অংশ নিতে পারবে এবং এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে যেতে পারবে অপেক্ষাকৃত সহজে।
সমপ্রতি ‘বহু-গতির’ (মাল্টি-স্পিড) ইউরোপ ধারণায় হঠাৎ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ ইইউ নেতারা এটা দিয়ে আসলে যা বোঝাতে চান তা হলো- প্রতিরক্ষা, আর্থিক বা কল্যাণ বিষয়ক নীতির ক্ষেত্রগুলোতে মূল সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অভিন্ন স্বার্থ এগিয়ে নিতে পারা উচিত; এর অর্থ- সবগুলো দেশ একই গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আরও বিস্তৃত একটি ‘মাল্টি-টায়ার’ ইউরো, জোটের বাইরে রাষ্ট্রগুলোর জন্যও স্থান খুঁজে পারে। মহাদেশটি ৪৮টি দেশ আর ৭৫ কোটি মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। ইইউ জোটে রয়েছে ২৮ দেশ আর ৫১ কোটি মানুষ। আর ইউরোজোনে তো আরও কম- ১৯ দেশ আর ৩৪ কোটি মানুষ।
ইউরোপের কেন্দ্র হবে ওই দেশগুলো যাদের রয়েছে অভিন্ন মুদ্রা। ইউরো’র সমস্যাগুলো সমাধানে আরও সমন্বয় ও অভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। যথাযথ একটি ব্যাংকিং জোট থেকে অভিন্ন ঋণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। পরবর্তী পর্যায়ে থাকবে ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঢিলেঢালা একটি গ্রুপ যারা ইউরোজোনে যোগ দিতে প্রয়োজনীয় সার্বভৌমত্বের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। এদের অনেকে হয়তো অনেক বছর ইউরোজোনে যোগ দেবে না। কেউ হয়তো কখনই দেবে না।
এর বাইরে মাল্টি-টায়ার একটি ইউরোপের উচিত ভিন্নমত পোষণকারী দেশগুলোকে স্থান দেয়া। এর অর্থ হবে যতটা না পরিবর্তিত চুক্তি, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তিত মানসিকতা। ইউরোক্র্যাটদের ভাষায়, খাবারের ‘আ লা কার্ট’ মেন্যু বেছে নেয়া, ‘প্রি ফিক্স’ নয়। পছন্দমতো ইইউ’র অংশবিশেষ বেছে নেয়ার ধারণায় ভ্রূকুটি করা হয় ব্রাসেলসে, কিন্তু ইউরোপিয়ানরা ক্রমাগত এমনটাই চাইছেন। নরওয়ে বা সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইউরোপের অভিন্ন বাজারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ থাকতে চাইতে পারে।
অন্যরা যেমন বৃটেন হয়তো অভিন্ন বাজারের নিয়ম কানুন মানতে প্রস্তুত নাও হতে পারে কিন্তু তারপরও ইইউ’র সঙ্গে যতটা মুক্তভাবে সম্ভব বাণিজ্য করতে আগ্রহী। তারা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার মতো অন্য ক্ষেত্রগুলোতে বৃহত্তর ভূমিকা চাইতে পারে। আর তুরস্ক, পশ্চিম বল্কান, ইউক্রেইন ও জর্জিয়ার মতো স্থানগুলো হয়তো আজকের অসন্তোষজনক পরিস্থিতির পরিবর্তে ওইরকম সংশ্লিষ্টতার অবস্থান পছন্দ করবে। এখন তাদের বলা হয় যে তারা পূর্নাঙ্গ সদস্য হওয়ার যোগ্য কিন্তু তারা জানে- তাদের কখনই যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না।
সফল হতে হলে, বহুধাপবিশিষ্ট ইউরোপকে প্রতিটি ধাপের নিয়মকানুন নিয়ে প্রয়োগবাদী হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বাইরের ধাপের সদস্যরা হয়তো জনসাধারণের মুক্ত চলাচল মেনে নাও নিতে পারে, কিন্তু এ কারণে ইইউ’র অভিন্ন বাজারে তাদের প্রবেশ বন্ধ করা উচিত হবে না। আর, কেন্দ্রের বাইরের সদস্যদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদার কোনো তকমাও থাকা উচিত নয়। তাছাড়া, এদের মধ্যে রয়েছে ডেনমার্ক ও সুইডেন; ইউরোপের সবথেকে সফল দেশগুলোর মধ্যে দু’টি। সামরিক বা কূটনৈতিক সক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলোর জন্য পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে যোগ দেয়ার পন্থা খুঁজে বের করা উচিত (ব্রেক্সিটের পর)।
ইউরোপীয় প্রকল্পকে যদি আরও ৬০ বছর টিকে থাকতে হয়, তাহলে এর চাবিকাঠি হলো নমনীয়তায়। সেটা দু’দিকেই। বৃটেন যেমন ইইউ ছেড়ে যাচ্ছে, তেমনি একদিন অপর একটি দেশ ইউরোজোন ছেড়ে যেতে পারে। এমন কোন কিছু মোকাবিলা করাটা কঠিন হবে। কিন্তু এ জোট যদি মতের বৈচিত্র্যকে আপন করে নিতে না পারে, তাহলে তা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
[বৃটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ‘ক্যান ইউরোপ বি সেইভড’- শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদন থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন হাসনাইন মেহেদী।] এমজমিন
মন্তব্য চালু নেই