ইউনূস বিষয়ে জয়কে হুমকি দিত হিলারির দপ্তর
বাংলাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল হিলারি ক্লিনটনের পররাষ্ট্র দপ্তর। পররাষ্ট্র দপ্তরে হিলারি ক্লিন্টনের সহকারীরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার প্রযুক্তি বিষয়কব উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে বিভিন্ন হুমকি দিতেন বলে জানা যায়। তারা জয়ের আর্থিক হিসাব নিয়ে তদন্ত শুরুর হুমকি দেয় বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনুসন্ধানী সংবাদপত্র দি ডেইলি কলার।
সজীব ওয়াজেদ জয়কে উদ্ধৃত করে ওয়াশিংটনভিত্তিক দি ডেইলি কলার তাদের সেই এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদনে জানায়, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা একাধিকবার তাকে চাপ দেন, যাতে তিনি ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করার বিষয়ে তার মাকে রাজি করান।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে বিশ্ব ব্যাংক। ওই বছরই বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও হেরে যান তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ নিয়ে ইউনূসের ‘নানা তৎপরতার’মধ্যে ২০১২ সালের জুনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েনের এক পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ করে দিয়ে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণে হাত দেয় বাংলাদেশ সরকার।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ইউনূসের নির্ধারিত বয়সের চেয়ে বেশি সময় থাকা বৈধ ছিল কি না এবং আর্থিক অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ২০১২ সালের মে মাসে তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ সরকার।
ওই তদন্ত ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে চাপ দেওয়া হয় বলে ডেইলি কলারের প্রতিবেদনের ভাষ্য।
২০১৫ সালে হিলারির ফাঁস হওয়া ই-মেইলেও ইউনূসের জন্য তদবিরের বিষয়টি প্রকাশ পায়। ইউনূসকে সরানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাপ আসার কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন।
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের যোগসাজশকে দায়ী করে গত ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থায়ন বন্ধের হুমকি এসেছিল, জয়কেও ‘ভয় দেখানো’ হয়েছিল।
শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউনূসের সঙ্গে ক্লিনটন পরিবারের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি বহুবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
বিল ক্লিন্টন যখন আরকানসাসের গভর্নর ছিলেন তখন ক্লিন্টন পরিবারের সাথে খাতির হয়েছিল মুহাম্মদ ইউনূসের। ২০০৬ সালে ক্লিন্টনের নোবেল জয়ের পেছনে বিল ক্লিন্টনের লবিংয়ের হাত রয়েছে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে জানা যায়।
আবার ২০১০ সালে ড ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক বেসামরিক পুরস্কার প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল অব ফ্রিডম জেতার পেছনেও হিলারি ক্লিন্টন প্রভাব রেখেছেন বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন নিউইয়র্কের সিনেটর থাকা হিলারি ক্লিন্টন সহজেই বারাক ওবামাকে প্রভাবিত করেছেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
গতবছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান পার্টিঘেঁষা ডেইলি কলারেরই এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তার পদের প্রভাব খাটিয়ে ইউনূসকে এক কোটি ৩০ লাখ ডলারের তহবিল জুগিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ইউনূস এক লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলার ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দান করেছিলেন বলে ডেইলি কলারের দাবি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা জয়কে উদ্ধৃত করে ডেইলি কলারের এবারের প্রতিবেদনে বলা হয, তিনি বৈধভাবে ১৭ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, কখনও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ওই সময় পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ এনে তদন্ত শুরুর হুমকি দেন।
“তারা আমাকে বার বার বলেছে, ‘দেখ, ইউনূসের প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে, আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লিনটনের বিষয়টাতো সবাই জানে’।”
ডেইলি কলার লিখেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি দুই দফা হিলারির সঙ্গে বৈঠক করেন। ডেইলি কলার নিউজ ফাউন্ডেশনকে তিনি তখন বলেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের সঙ্গে ইউনূসের যোগাযোগ আছে বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়।
বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপু মনি ডেইলি কলারকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার বা তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনো চাপ সে সময় ছিল কি না আমি বলতে পারব না। আমি শুধু বলতে চাই, এখানে দুটো বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত স্টেট ডিপার্টমেন্টের যোগাযোগ এবং দ্বিতীয়ত বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহার।”
ইউনূসের বিষয়ে দীপু মনি বলেন, “অবশ্যই অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ সরকারকে, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে হেনস্থা করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, আমাদের দেশের জন্য, সরকারের জন্য পদ্মা সেতু কতটা গুরুত্বপূর্ণ।… অবশ্যই তিনি সেটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।”
জয় ডেইলি কলারকে বলেছেন, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসসহ স্টেট ডিপার্টমেন্টের নানা পর্যায় থেকে সে সময় তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সেই এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদনটিতে বলা হয় ভার্জিনিয়ায় বসবাস করায় জয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হতো। সাধারণত তাদের মধ্যে বাণিজ্য বা নিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও ২০১০ এর পর তা দ্রুত বদলে যেতে থাকে।
“তখন তারা কেবল একটা প্রসঙ্গই টেনে আনত, আর তা হলো ইউনূস। মুহাম্মদ ইউনূসকে বাঁচাতে হবে- এটা তাদের অবসেশনে পরিণত হয়েছিল,” বলেন জয়।
ডেইলি কলার বলছে, এ বিষয়ে তারা গ্রামীণ আমেরিকা ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের বক্তব্য জানার চেষ্টা করলেও সাড়া পায়নি।
মন্তব্য চালু নেই