আবার আকাশে অন্তর্ধান
আরও উঁচুতে যেতে চাই বলে উধাও বিমান, নিখোঁজ ১৬২
আবারও মাঝ-আকাশে উধাও হয়ে গেল যাত্রিবাহী বিমান। এবং আবারও সেই মালয়েশীয়-যোগ!
এক বছরে এই নিয়ে তিন বার!
রবিবার সকালে ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে ১৫৫ জন যাত্রী ও ৭ জন কর্মী নিয়ে মাঝ আকাশে উধাও হয়ে গেল এয়ার এশিয়ার বিমান কিউজেড-৮৫০১। এর আগে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ-৩৭০ এবং এমএইচ-১৭। ঘটনাচক্রে যে ইন্দোনেশীয় বিমানটি এ দিন উধাও হয়ে গেল, সেটিতে এয়ার এশিয়ার মালয়েশিয়া শাখার বড় অংশীদারি রয়েছে।
রবিবার সকাল ৫টা ২০তে ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া থেকে আকাশে ওড়ে কিউজেড-৮৫০১। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে তার পৌঁছনোর কথা ছিল সকাল সাড়ে আটটায়। আবহাওয়া খারাপ থাকায় যাত্রা শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) কাছে উড়ানের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য অনুমতি চেয়ে বার্তা পাঠান চালক। তার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার এটিসি-র সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এয়ারবাস এ৩২০-২০০-র।
এ দিন সকালেই সাংবাদিক বৈঠক করে বিমান-নিখোঁজের কথা জানান ইন্দোনেশিয়ার বিমান পরিবহণ কর্তৃপক্ষ। বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার কথা লেখা রয়েছে এয়ার এশিয়ার ফেসবুক পেজেও। দুর্ঘটনার আভাস পেয়ে তাদের উজ্জ্বল লাল রঙের লোগো এ দিন বদলে গিয়েছে ধূসর রঙে। বিমান সংস্থার দাবি, উড়ানে যে পরিমাণ জ্বালানি ছিল, তা বহু ক্ষণ আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় সময় যত গড়াচ্ছে, যাত্রীদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ হচ্ছে।
বিমানটির খোঁজে রবিবার দিনভর জাভা সাগরে তল্লাশি চালিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার সেনা বিমান। এক বার শোনা গিয়েছিল, বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে জল্পনাও শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী বিবৃতি জারি করে জানিয়ে দেন, এটা নেহাতই গুজব। দিনভর তল্লাশি চালিয়ে সন্ধ্যার মুখে প্রতিকূল আবহাওয়া ও অন্ধকারের জন্য উদ্ধারকাজ থামিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, সোমবার ভোর থেকে ফের নিখোঁজ বিমানটির খোঁজে তল্লাশি শুরু হবে।
নিখোঁজ বিমানের ১৫৫ জন যাত্রীর অধিকাংশই ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার তিন জন, সিঙ্গাপুরের এক জন এবং মালয়েশিয়া ও ফ্রান্সের এক জন করে যাত্রী ছিলেন। যার মধ্যে এক সদ্যোজাত-সহ ১৭টি শিশুও ছিল। তবে যাত্রীদের মধ্যে কোনও ভারতীয় ছিলেন না।
সরকারি সূত্রে খবর, ইন্দোনেশিয়ার বন্দর শহর তানজুং পানডন থেকে বোর্নিওর পন্টিয়ানকের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এটিসির সঙ্গে শেষ বার কথা হয়েছিল বিমান চালকের। সে সময় বিমানটির উচ্চতা ছিল ৩২ হাজার ফুট। গতিপথ বদলে চালক ৩৮ হাজার ফুট উচ্চতায় বিমানটিকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান এটিসি-র কাছে। এর অল্পক্ষণের মধ্যেই রেডার থেকে মুছে যায় কিউজেড-৮৫০১-র ছবি।
বিমান অন্তর্ধানের সময় নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই নানা রকম তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। এয়ার এশিয়ার তরফে জানানো হয়েছে, সকাল ৭টা ২৪ মিনিটের পর থেকে বিমানটির আর খোঁজ মিলছে না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া প্রশাসনের দাবি, নিখোঁজ হওয়ার সময়টা আসলে সকাল ৬টা ১৭ মিনিট। আবার ইন্দোনেশিয়ার এটিসি সূত্রের দাবি, ওড়ার ৪২ মিনিট পর থেকেই বিমানটির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই অনুযায়ী হিসেব করলে সময়টা সকাল ৬টার কাছাকাছি। তাই বিমান-অন্তর্ধানের প্রকৃত সময় নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
আবহবিদেরা জানিয়েছেন, এ দিন সকালে ইন্দোনেশিয়ার ওই অঞ্চলে আবহাওয়া যথেষ্টই খারাপ ছিল। প্রচণ্ড মেঘ, তার সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছিল। তবে তাঁদের দাবি, আকাশের যে উচ্চতায় এই দুর্যোগ চলছিল, সাধারণত বিমান তার থেকে উঁচু দিয়ে যায়। ফলে দুর্যোগে পড়লেই যে বিমান ভেঙে পড়বে, এমনটা সব সময় হয় না বলেও মনে করিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। এর আগে ইন্দোনেশীয় এয়ার এশিয়ার কোনও বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েনি। কিউজেড-৮৫০১ এর চালক ও কো-পাইলট দু’জনের অভিজ্ঞতাও দীর্ঘদিনের। তা সত্ত্বেও বিমানটি কী ভাবে হারিয়ে গেল, তা ভেবে পাচ্ছেন না অনেকেই।
এশিয়ার দেশগুলিতে সস্তা উড়ানের দৌলতে এয়ার এশিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই বেশ জনপ্রিয়। এদের গন্তব্য তালিকায় রয়েছে ১০০টিরও বেশি জায়গা। রবিবার যে বিমানটি উধাও হয়ে গেল, সেটির মালিকানা এয়ার এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া শাখার। এই সংস্থার ৪৯% শেয়ার রয়েছে মালয়েশীয় এয়ার এশিয়ার হাতে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইন্দোনেশীয় এয়ার এশিয়ার উড়ান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১০-এ সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
বিমান উধাওয়ের খবর পাওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই তল্লাশি অভিযান শুরু হয়ে যায়। জানা যায়, তানজুং পানডন থেকে একশো নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ পূর্বে শেষ বার দেখা গিয়েছিল বিমানটিকে। জাভা সাগরের ওই অংশে তল্লাশি শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর দু’টি বিমান এবং একটি হেলিকপ্টার। আগামী কাল থেকে তল্লাশি অভিযানে যোগ দেবে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর। সমুদ্রে নজরদারি চালানোর বিমান ও তিনটি জাহাজ তৈরি রেখেছে ভারতও। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে চিন। প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে তারা। বড়দিনে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এয়ার এশিয়ার বিমান উধাওয়ের বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়েছে হোয়াইট হাউসের তরফে।
বিমান বেপাত্তা হওয়ার খবর পেয়ে সুরাবায়া ও চাঙ্গি দুই বিমানবন্দরেই ছুটে এসেছেন নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় দশ ঘণ্টা পর এ নিয়ে মুখ খুলেছেন ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কাল্লা। তিনি জানান, “আশঙ্কা করা হচ্ছে দুর্ঘটনার কবলেই পড়েছে কিউজেড-৮৫০১।” ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে গিয়েছেন এয়ার এশিয়ার গ্রুপ সিইও টনি ফার্নান্ডেজ। দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি এমন হবে মন্তব্য করেছেন তিনি। এই দুঃসময়ে কর্মীদের মন শক্ত করার আবেদনও জানিয়েছেন ফার্নান্ডেজ। উদ্বিগ্ন আত্মীয়দের জন্য বিশেষ ফোন লাইন চালু করেছে এয়ার এশিয়া। তবে পরিজনদের অনেকেরই অভিযোগ, বিমান সংস্থা তাদের কিছুই জানায়নি। টিভির খবর দেখে তাঁরা বিমানবন্দরে এসেছেন নিখোঁজ আত্মীয়ের সন্ধানে।
আগের দু-দু’টো বিমান বিপর্যয়ের ক্ষত এখনও টাটকা। দশ মাস আগে এ রকম ভাবেই মাঝ সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের এমএইচ-৩৭০। কুয়ালা লামপুর থেকে বেজিং-গামী ওই উড়ানে ছিলেন ২২৭ জন যাত্রী ও ১২ জন বিমান কর্মী। ভারত মহাসাগর তোলপাড় করেও আজ অবধি খোঁজ মেলেনি সেই বিমানের। এর চার মাসের মাথায়, ৩০০ জন যাত্রীসমেত মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের এমএইচ-১৭-কে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইউক্রেনের আকাশে ধ্বংস করে দেয় রুশ-পন্থী জঙ্গিরা।
এক বছরে জোড়া বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্স আজ পাশে দাঁড়িয়েছে এয়ার এশিয়ার। মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের টুইটারে জ্বলজ্বল করছে, ‘তোমাদের উদ্বেগ আর প্রার্থনার সঙ্গে মিশে রইলাম আমরাও’।
মন্তব্য চালু নেই