‘আমি কেন আরও ইহুদি মারলাম না’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক বছর। কিন্তু আজও জার্মান নাৎসি বাহিনীর অনেক ফেরার সদস্যকে রাখা হয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায়। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকুক না কেন, তাদের গ্রেপ্তার করে এনে নেদারল্যান্ডের হেগের বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হয়। কিন্তু এখনও সব নাৎসি অফিসারকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি জার্মান আদালত। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলোইস ব্রুনার। ১৯৫০ সাল নাগাদ জার্মানি থেকে পালিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন সিরিয়াতে। সেখানে নিজের নাম পরিবর্তন করে ভিন্ন নামে তৎকালীন সিরীয় শাসকের প্রধান সামরিক উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তবে সম্প্রতি এক সংবাদ মারফত জানা যায়, ২০১০ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে মারা গিয়েছেন এই যুদ্ধাপরাধী ব্রুনার।
বেঁচে থাকলে ব্রুনারের বয়স হতো এখন ১০২ বছর। জীবদ্দশায় তাকে অ্যাডলফ এইচম্যানের ডান হাত বলা হতো। কারণ প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার ৫০০ ইহুদিকে হত্যার যে ডিজাইন করেছিলেন এইচম্যান, তার মূল পরামর্শক ছিলেন ব্রুনার। ১৯১২ সালে অস্ট্রিয়াতে জন্মানো ব্রুনার হিটলারের আমলে জার্মানি এসএস বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এসএস বাহিনীর সদস্যা থাকাকালীন সময়েই তিনি এইচম্যানের নজর কাড়েন। ব্রুনারের নীলনক্সা আর এইচম্যানের পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন করেন হিটলার স্বয়ং তার ‘ফাইনাল সলিউশ্যান’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে। অবশ্য যুদ্ধের পর এইচম্যান পালিয়ে আর্জেন্টিনা চলে গেলেও সেখানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাতে ধরা পরেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তাকে ইসরায়েল সরকার ১৯৬২ সালে হত্যা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রুনার ৪৭ হাজার ইহুদিকে অস্ট্রিয়া, ৪৪ হাজার গ্রিসে, ২৩ হজার ৫০০ ফ্রান্সে এবং স্লোভাকিয়াতে ১৪ হাজার ইহুদিকে বন্দী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই ওই ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল। হিটলারের ফাইনাল সলিউশ্যান প্রকল্পের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ব্রুনার ইহুদি নিধনে সর্বাধিক অবদান রেখেছিলেন ফুয়েরারের সময়ে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের আদালত ব্রুনারের অনুপস্থিতিতেই তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়। কিন্তু সিরিয়ার তৎকালীন সরকার তার দেশে ব্রুনারের উপস্থিতি অস্বীকার করার কারণে তাকে বিচারের মুখোমুখি দাড় করানো সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক আদালতের।
তাই বলে ব্রুনারকে হত্যার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। দুইবার চিঠি বোমার আঘাতে আক্রান্ত হন তিনি। তবে এই বোমা হামলায় তার জীবন না গেলেও তার হাতের আঙ্গুল ও একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৬০ এবং ১৯৮০ সালের দিকে এই হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এতোকিছুর পরেও ব্রুনারকে ধরাছোয়ার মধ্যে পায়নি পৃথিবীর কোনো আদালত। মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর সিমন উইচেনথাল সেন্টার তাদের তালিকা থেকে ব্রুনারের নাম তুলে নেয়। এই সেন্টারটি প্রতিবছর পলাতক নাৎসি সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করে।
ব্রুনার তার জীবদ্দশায় সর্বশেষ একটি জার্মান নিউজম্যাগাজিনের সামনে মুখ খুলেছিলেন ১৯৮৫ সালে। সেখানে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে তার জীবনে কোনো আফসোস আছে কিনা। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একটাই মাত্র আফসোস, আর তা হলো আমি কেন আরও বেশি ইহুদিকে হত্যা করতে পারলাম না’।
মন্তব্য চালু নেই