ইউনাইটেড হাসপাতালে ভূতুড়ে বিল

‘আব্বাকে বসিয়ে রেখে বিলের জন্য তো আর ফাইট করতে পারি না’

আমার বাবা ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাকে এমআরআই করার জন্য চিকিৎসকেরা ‘প্রেসক্রাইব’ করেন (পরামর্শ দেন)। কিন্তু দেখা গেল, ইউনাইটেড হাসপাতালের এমআরআই মেশিন অকেজো। পরবর্তীতে ইউনাইটেড থেকে তাকে জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল এমআরআই করার জন্য পাঠানো হয়। সিকদার মেডিক্যালে এমআরআই করানোর পর তার বিল এলো ১৪ হাজার টাকা। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকা ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্মী জানান, এখানে আমাদের বিল দিতে হবে না। কারণ, সিকদারের বিলটা ইউনাইটেড হাসপাতাল দিয়ে দেবে। আর আমরা ইউনাইটেডের অন্যসব বিলের সঙ্গে এই বিলটাও দিয়ে দেবো। কিন্তু ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে যখন আমাকে পুরো বিল দেওয়া হলো, তখন সেখানে এমআরআই পরীক্ষার জন্য বিল লেখা ছিল ২৩ হাজার টাকা। কেন ২৩ হাজার টাকা এমআরআই বিল করা হলো জানতে চাইলে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, এটাই তাদের এমআরআই পরীক্ষার খরচ।

ভুক্তভোগী পুত্র মহসিন আহমেদ বলেন, আমার বাবার বয়স ৯০ বছর হলেও তিনি শারীরিকভাবে ভালোই আছেন। শুধুমাত্র উনার একটু হাইপো-গ্লাসিমিয়ার টেন্ডেন্সি রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি অসুস্থবোধ করলে আমরা তার সুগার লেভেল ঠিক করার জন্য অন্যান্য সময়ে যা করি, একটু মিষ্টি কিংবা চকোলেট খেতে দেই, তাই করলাম। সেদিন অনেক কিছু করার পরেও যখন স্বাভাবিক হচ্ছিলেন না, তখন দুই ঘণ্টা পর তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন রাত দশটার মতো বাজে। সেখানে ইমারজেন্সিতে তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়, বলা হয় ইউরিনে একটু সমস্যা থাকায় ক্যাথেড্রার দেওয়া হলো। এক ঘণ্টার ভেতরে তিনি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। তখন জরুরি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, আমরা রোগীকে হাসপাতালে রাখবো নাকি নিয়ে যাবো? তাকে আমি বললাম, আপনারা যা ভালো মনে করবেন আমরা তাই করবো। ওনারা একদিন রাখতে বললেন। আমরা রাখলাম। আমার বাবার ব্যাকবোনে একটু সমস্যা থাকায় চিকিৎসক আনিসুর রহমান সাহেবের চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাবা তাকে বললেন, পেছনে একটু ব্যথা হচ্ছে। আনিসুর রহমান বাবাকে একটি এমআরআই করার জন্য পরামর্শ দেন। আমরা যখন সেখানে এমআরআই করাতে গেলাম তখন বলা হলো তাদের এমআরআই মেশিন নষ্ট।

মেশিন নষ্ট থাকায় ওইদিন এমআরআই করা হলো না। এদিকে আমরা টাকা গুনছি। পরের দিন আমি বললাম, শুধুমাত্র এমআরআই করার জন্য এখানে বসে আছি, যেখানে কেবল রুম ভাড়াই প্রতিদিন নয় হাজার টাকা।অন্যান্য সবকিছু নিয়ে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে কোনও চিকিৎসা ছাড়াই। কারণ, শুধুমাত্র এমআরআই ছাড়া তার কোনও চিকিৎসার দরকার ছিল না। তখন ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, তাদের মেশিন সেদিনও ঠিক হয়নি, আমাদেরকে সিকদার মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমআরআই করতে বলা হলো। আমি তাদের বললাম, রোগী আপনাদের এখানে ভর্তি রয়েছে, ওনার যা যা দরকার সব আপনাদেরই করতে হবে।তারা বলে, ঠিক আছে আমরা করিয়ে আনছি। ওনারা যখন সিকদার মেডিক্যালে যান সঙ্গে আমিও ছিলাম।

আমরা সেখানে এমআরআই করালাম এবং তখন বিল দেওয়া হলো ১৪ হাজার টাকা।যখন বিল দিতে গেলাম সঙ্গে থাকা ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রতিনিধি আমাকে বলেন, এটা হসপিটাল টু হসপিটালের বিষয়। যখন রোগী রিলিজ করা হবে তখন এখানকার বিলটা পুরো বিলের সঙ্গেই ইউনাইটেডকে দিতে হবে।

২ ফেব্রুয়ারি যখন বাবাকে ডিসচার্জ করা হয়, তখন মোট বিল দেওয়া হলো ৮৭ হাজার ২৬২ টাকা। এর ভেতরে এমআরআইয়ের জন্য বিল করা হয়েছে ২৩ হাজার টাকা। তাদের প্রশ্ন করলাম, ১৪ হাজার টাকা কী করে ২৩ হাজার হলো? তাদের জবাব, ইউনাইটেড হাসপাতালে এমআরআই’র রেট ২৩ হাজার টাকাই। তাদের বললাম, এই হাসপাতালে এমআরআই করানো হয়নি, তাহলে কেন এটা এই হাসপাতালের রেট ধরা হবে। আমার কাছে যেখান বিল রয়েছে ১৪ হাজার টাকা, সেখানে কেন ২৩ হাজার টাকা চার্জ করা হবে, নয় হাজার টাকা কেন বেশি করা হবে। আপনি কি এটা নৈতিকভাবে করতে পারেন?

কার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো জানতে চাইলে মহসিন আহমেদ বলেন, কথা হচ্ছিল চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে। আমি বারবার তার নাম জানতে চেয়েছি কিন্তু তিনি নাম বলতে অস্বীকার করেছেন। তখন তিনি আমাকে বলেন,ডিউটি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ডিউটি ম্যানেজার আমাকে রিফিউজ করেন যে, তিনি দেখা করতে চান না। তিনি বলেন, আপনার যা বলার ফোনে বলেন। তাকে বলি, আমি আপনার খুব কাছেই হাসপাতালের ভিতরে রয়েছি কেন ফোনে বলবো, আপনার সঙ্গে আমি দেখা করে কথা বলতে চাই। তিনি আমাকে জবাব দেন, দিজ ইজ নান অব মাই বিজনেস, এটা অ্যাকাউন্টের বিষয়।

আমি তাকে আমি বলি, অ্যাকাউন্টস বিভাগ আমাকে সাহায্য করছে না। তখন তিনি আমাকে ফিরতি জবাব দেন তাহলে আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। তাকে তখন বলি, আপনার কাজ কী তাহলে। তিনি তখন আমাকে জবাব দেন, আমি আপনাকে বলবো না যে আমার কাজ কী। আমি তাদেরকে বারবার বলেছি যে, একজন রোগীকে এমআরআই করিয়েছেন আরেকটা হাসপাতালে। সেখানে বিল হয়েছে ১৪ হাজার টাকা, সেই বিল এখানে এসে হলো ২৩ হাজার টাকা। এই নয় হাজার টাকার মার্কআপ কিভাবে করেন, আপনি কী নৈতিকভাবে এটা ঠিক করছেন কিনা, আমার আর কোনও প্রশ্ন নাই। শুধু এটাই প্রশ্ন আমার।‘This is too much unethical, you cann’t do this.’ আপনি এখানে প্রফিট করতে পারেন না, এটা যদি আসল বিল হতো আমার কোনও কথা ছিল না। এখানে নয়হাজার টাকা বিল করা হয়েছে অনৈতিকভাবে। বাকি টাকা নিয়ে কোনও কথা আমি বলছি না। তখন আমার বাবাকে বসিয়ে রেখেছে। সেই অবস্থায় তাকে বসিয়ে রেখে তো আমি আর ফাইট করতে পারি না। তারা আমাদের রিলিজও করছিল না। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কী করি। তাদের বলেছি, আমি কোনও সেলিব্রেটি না যে আমাকে রিকোগনাইজ করা যাবে। কিন্তু অন্য কেউ হলে এটা করবেন আমার জন্য করবেন না, এমন কিছু কী বিষয়টি।

c8c081cae4553fb7700cd0285b48f54b-

তখন আমি ঠিক করলাম যে, সাধারণভাবে তো কিছু করতে পারবো না। কিন্তু আমি আমার ভয়েস রেইজ করবো। আমি ইমেইলের মাধ্যমে কনজ্যুমারস রাইট প্রোটেকশন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ক্যাবকে জানিয়েছি । তারা উত্তর দিয়েছে, তারা একটি পাবলিক হিয়ারিং (গণশুনানি ) করবে। ক্যাব যদি কিছু না করতে পারে তাহলে আমি আইনি লড়াইয়ে যাবো। কোনওভাবেই বিষয়টিকে আমি এভাবে ছেড়ে দেবো না। কাউকে না কাউকে বিষয়টি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। কোনওভাবেই এটিকে চুপচাপ ছেড়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, আমি তাদের অনুরোধ করেছি, এটা অনৈতিক কিন্তু তারা শোনেনি।

উল্লেখ্য, এ বিষয়ে কথা বলতে ইউনাইটেড হাসপাতালে ফোন করে পরিচয় দিয়ে চিফ অ্যাকাউনটেন্ট মো. মজিবুর রহমানকে চাইলে প্রথমে লাইন শিফট করা হয় যেখানে, সেখান থেকে বলা হয় এটা ভেকসিনেশন বিভাগ, এখানে কেন ফোন করেছেন। সেখানেও চিফ অ্যাকাউনটেন্ট সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, আবারও ফোনে ধরিয়ে রাখা হয়। প্রায় সাড়ে চার মিনিট পরে বলা হয়, স্যার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলবেন না। বাংলা ট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই