অবশেষে মুখ খুললেন সুজাতা
বেশিদিন নয়, গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সে স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল। এই ২৮ জানুয়ারি সেই সুজাতা সিং বরখাস্ত হলেন। এতে অনেকেই চমকে গিয়েছিলেন।
চমকাবার মতো কারণও আছে। যার অবসরের মাত্র বাকি আছে সাত মাস, তাকে কেন এখনই বরখাস্ত! সে কারণটি নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন স্বয়ং সুজাতা সিং। বলব না বলব না করেও ক্ষোভটা প্রকাশ্যে এনেই ফেললেন। অবসরের সাত্র সাত মাস বাকি থাকতে যে ভাবে তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হলো, তা নিয়ে শুক্রবার মিডিয়াতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, ‘আমার সম্মান ভূলুণ্ঠিত হলো। এটার কি খুব দরকার ছিল?’ খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
ক্ষোভ প্রকাশ করে সুজাতা অকপটে জানান, গত আঠারো মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেই সব কাজ করে গিয়েছেন। বিনিময়ে সেখান থেকে শুধুই নেতিবাচক মন্তব্যই শুনতে হয়েছে তাকে। এটা পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেন সুজাতা। জানান, দিনের পর দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকের জন্য চেষ্টা করেও সেই সুযোগ পাননি তিনি। এবং সে কারণেও সুজাতা মনে করছেন, আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করা ছিল।
পরিকল্পনা অবশ্য একটা ছিলই। সেটা এখন আর গোপন কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বক্তব্য অন্য কোনও মাপকাঠিতে নয়, কূটনীতিবিদ হিসেবে যে রেকর্ড রয়েছে জয়শঙ্করের, তাতেই তিনি এই পদের ‘অটোমেটিক চয়েস’। ৩১ তারিখই তার অবসর নেওয়ার কথা ছিল। তার আগেই তাকে বিদেশসচিব নিয়োগ করাটা জরুরি ছিল। সময়ের এই অঙ্ক মেলানোর চেষ্টাতেও সরতে হয়েছে সুজাতাকে। তাই অঙ্ক কষেই এই অপসারণ মনে করছেন সুজাতা।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বক্তব্য, এত দিন সুজাতার কাজে কোনও সমস্যা তৈরি করা হয়নি। ব্যাকরণ মেনে তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েই আগে থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে তাকে। বরখাস্ত করা হয়নি, বরং পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। আঠাশ বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সাংবাদিক বৈঠকে বসে আচমকাই বরখাস্ত করেছিলেন তখনকার বিদেশসচিব এ পি বেঙ্কটেশ্বরনকে। সেই সাংবাদিক বৈঠকে তখন খোদ সচিব উপস্থিত।
এ রকম কোনও অপমানের মধ্যে সুজাতাকে ফেলতে চাননি মোদি। আবার জয়শঙ্করের মতো দক্ষ কূটনীতিক ৩১ জানুয়ারি অবসর নিয়ে নিলে তাকে বিদেশসচিবের পদে আনার সুযোগ হাতছাড়া হতো মোদির।
আনন্দবাজার পত্রিকার খবরটিতে বলা হয়, জয়শঙ্করকে দু’বছর আগেই বিদেশসচিব পদে চেয়েছিলেন মনমোহন। জয়শঙ্করের যোগ্যতা নিয়ে মনমোহন এতটাই আস্থাবান ছিলেন যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে বিদেশসচিব করতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সোনিয়ার আপত্তিতে পেরে ওঠেননি। এত দিন পরে যোগ্যতার মাপকাঠিতেই জয়শঙ্করকে শেষ পর্যন্ত বিদেশসচিবের আসনে বসালেন মোদি।
খবরটিতে আরো বলা হয়, মোদির সঙ্গে জয়শঙ্করের ব্যক্তিগত রসায়নের একটি ইতিহাসও রয়েছে। ২০১২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি যখন চীন সফরে গিয়েছিলেন জয়শঙ্কর তখন সেখানকার রাষ্ট্রদূত। সেখানে বেশ কিছ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আয়োজনের ক্ষেত্রে জয়শঙ্করের তৎপরতায় মুগ্ধ হন মোদি। এক মুখ্যমন্ত্রীর জন্য এই সক্রিয়তা তখনই নজর কেড়েছিল মোদির। পরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ধীরে ধীরে তার উপর নির্ভরতা তৈরি হয় মোদির।
সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফর এবং সদস্যসমাপ্ত প্রজাতন্ত্র দিবসে বারাক ওবামার সফরকে সফল করে তুলতে প্রবল সক্রিয় ছিলেন জয়শঙ্কর ও তার অফিস। মনমোহন জমানার শেষ দিকে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে নেমেছিল। হিমঘরে চলে যাওয়া পরমাণু চুক্তি, প্রতিরক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কের যে অভাবনীয় উন্নতি গত চার মাসে দেখা যাচ্ছে, জয়শঙ্করই তার অন্যতম রূপকার বলে মনে করছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
জয়শঙ্করের দীর্ঘ ছায়ায় নিজের যাবতীয় প্রয়াস আড়ালে চলে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সুজাতা। সেই ক্ষোভও প্রকাশ পায় সুজাতার শুক্রবারের সাক্ষাৎকারে। সুজাতা বলেন, ‘ওবামার সফরের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি আমরা পরিশ্রম করে তৈরি করেছি। আমার মন্ত্রকের অফিসাররা করেছেন। পরমাণু চুক্তি নিয়েও যথাসাধ্য পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু সর্বদাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে।’
কেন এই নেতিবাচক মনোভাব? প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এক অফিসারকে সুজাতা প্রশ্নও করেছিলেন এ নিয়ে। সুজাতা বলেন, ‘উত্তরে বলা হয়েছিল যে এটা ব্যক্তিগত ভাবে নেওয়ার কিছু নেই, সব মন্ত্রকের সঙ্গেই নাকি এমনটা হয়ে থাকে!’ সুজাতার দাবি, গত আট মাসে বিদেশনীতিতে মোদী যে ঝড় তুলেছেন, তার অন্যতম কান্ডারি ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের ঢাক নিজে পেটান না বলে এবং ব্যক্তি নয় দলবদ্ধ কাজে বিশ্বাস করে এসেছেন বলে, আজ তাকে দাম দিতে হল।
মন্তব্য চালু নেই