অদ্ভুত সব মৃত্যুযান

কিছুদিন আগেই যুক্তরাজ্যের এক মাঠ খুঁড়ে পাওয়া যায় ১৭শ’ বছর পুরোনো এক শিশুর কফিন। ধারণা করা হয় সীসা দ্বারা নির্মিত ওই কফিনটি তৃতীয় শতকের রোমান কোনো ধনী ব্যক্তির শিশু সন্তানের। এতো গেল যুক্তরাজ্যের কথা। কিন্তু ধরুন আপনারই বাড়ির উঠোন খুড়ে যদি এমন কফিন অবিস্কার করেন যার আকৃতি ডাইনোসরের মতো, তাহলে বেশ অবাক হবারই বিষয়। না পাঠক, নিশ্চিত থাকুন আপনার নিবাস যদি আফ্রিকার ঘানা না হয় তাহলে এটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।

ঘানার প্রাচীন একটি আদিবাসী গোষ্ঠি গা-আদাঙবে। গোষ্ঠির মানুষদের সাধারণত ‘গা’ হিসেবেই সম্বোধন করা হয়। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠি মূলত বিখ্যাত তাদের বানানো বাহারি ঢংয়ের কফিনের জন্য। যেমন বাহারি তাদের কফিনের ঢং তেমনি বাহারি তাদের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া পালন অনুষ্ঠান। বিচিত্র সব আচারের ভেতর দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান। এর অবশ্য কারণও আছে। কারণ এই ‘গা’ জনগোষ্ঠির মানুষের বিশ্বাস মতে, যখন কোনো মানুষ মারা যায় তখন তারা পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করে। যে জীবনে মর্তের জীবনের তুলনায় অনেক গুন বেশি শান্তি অপেক্ষা করে আছে।
আর এই কারণেই ‘গা’ জনগোষ্ঠির মানুষ তাদের নিকটজনদের মৃত্যুর পর যে কফিনে তাদের রাখা হবে সেই কফিনটি খুব যত্ন করে দক্ষ কারিগর দিয়ে বানায়। কারুকার্যখচিত এই কফিনগুলোর নকশা মূলত মৃত ব্যক্তির পরিবারের ইচ্ছেয় অথবা খোদ মৃত ব্যাক্তির ইচ্ছে মাফিকও বানানো হয়। এখন সেই নকশা মামুলি পেনসিলও হতে পারে আবার অতিকায় দেখতে হাতিও হতে পারে। তবে মৃত ব্যক্তির ইচ্ছে যদি থাকে তাকে হাতি আকৃতির কফিনে ঢুকিয়ে অন্য জগতে পাঠাতে হবে, তাহলে আত্মীয় স্বজনরা যত কষ্টই হোক না কেন সেই হাতির পেটে চড়িয়েই তাকে অন্য জগতে পাঠান। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য কফিনগুলো নকশা করা হয় মৃতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পেশা অথবা তার গোত্রের প্রতীকী চিহ্নের রূপ অনুযায়ী।

কিন্তু প্রাচীন নিয়মানুযায়ী কফিনের এই অদ্ভুত ডিজাইনের ক্ষেত্রে সদ্য মৃতের পেশাকে মাথায় রাখার নিয়ম। কারণ তাদের বিশ্বাস, এই কফিনে চড়েই মৃত ব্যক্তি তার নতুন জীবনে প্রবেশ করবে। যে মানুষ জীবিত অবস্থায় ছিলেন গাড়ির চালক কিংবা মৎসজীবি অথবা সেলাই মেশিন চালক তার জন্য ওই পেশা অনুযায়ীই কফিন তৈরি করা হয়। তবে আধুনিক জীবনযাত্রার ছোয়া থেকে রেহাই পায়নি ‘গা’ জনগোষ্ঠি। তাইতো এখন তাদের কফিনের আকৃতি হয় কোকাকোলার বোতল, বিয়ার অথবা সিগারেট।
‘গা’ জনগোষ্ঠির একজন নামকরা কফিন ডিজাইনার হলেন আবলেদ গ্লোভার। তিনি শুধু কফিন নির্মাতাই নন, একই সঙ্গে একজন চিত্রকরও বটে। তার মতে, কফিন হলো মানুষের দ্বিতীয় নিবাস। যে নিবাসে মানুষটি মৃত্যুর পর বাস করবে। তাই এটি হতে হয় খুব সুন্দর। কিন্তু একটা কফিন সুন্দর নকশা করে সুচারুরূপে বানানো সম্পন্ন করতে বেশ সময় লাগে। তাই অনেক সময়ই তড়িঘড়ি করে কফিন বানানো হয় সাধারণ ডিজাইন দিয়ে। যেমন ধরা যাক, একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার মারা গেলেন। তো তার জন্য চাই গাড়ির আকৃতির একটি কফিন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই আকৃতির কফিন বানাতে অধিক সময় লাগবে এবং চাই অনেক খরচ। কারণ গতানুগতিক কফিন তৈরিতে যে সময় লাগে তারচেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে এই কফিন তৈরিতে। আর দক্ষ কারিগর ছাড়া একটা সুন্দর নকশা করা কফিন বানানোও সম্ভব নয়।

পৃথিবীর সব রহস্য আজো উন্মোচিত হয়নি মানুষের কাছে। আর তাই বোধকরি এখনও পৃথিবী নামক এই গ্রহটি এতো সুন্দর মানুষের কাছে। রহস্য শেষ হয়ে গেলে হয়তো একদিন এই পৃথিবীই মহাকালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবীর নানান প্রান্তে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া নিয়ে আছে নানান রীতি। যেমনটা আছে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পূর্বদিকের সাগাদা নামক জায়গায়। এখানকার মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনদের লাশ কবরে না নামিয়ে ছবির মতো করে পাহাড়ের গায়ে ঝুলিয়ে রাখে। কফিনগুলো সাজানো হয় বয়সের ভিত্তিতে। যে আগে মরে তার কফিন থাকে উপরে। এভাবে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে থাকে। এযেন কফিনের গায়ে পৃথিবীর বয়সের খতিয়ান।



মন্তব্য চালু নেই