অথৈ সাগরে আতঙ্ক বাংলাদেশের সীমান্ত
বিবাদ মিটে বিপত্তি বেড়েছে। চরম বিপত্তি।
ট্রলার নিয়ে মোহনা উজিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়ে এত দিন তাঁরা নিশ্চিন্তে খুঁজতেন মাছের ঝাঁক। এখন তার সঙ্গে ঠাওর করার চেষ্টা করেন, এই অথৈ জলে কোন অজানা জায়গায় ভারতের সীমান্ত শেষ হয়ে শুরু হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অধিকার।
কেঁদো কিংবা ধঞ্চি দেশের শেষ ভূখণ্ড পিছনে ফেলে এলেই মৎস্যজীবীরা এখন আতঙ্কে ভুগছেন, জল-সীমান্ত টপকে এলাম না তো! এই বুঝি সবুজ পতাকা উড়িয়ে ধেয়ে এল বাংলাদেশের তটরক্ষী বাহিনীর সাঁজোয়া বোট। ট্রলার সমেত ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরল!
‘কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতি’র সম্পাদক বিজন মাইতি বলেন, “কোনও কথা শোনার বালাই নেই। সীমান্ত লঙ্ঘনের দায়ে মৎস্যজীবীদের ধরে সটান ভরে দিচ্ছে হাজতে। মাসের পর মাস আটকে থাকতে হচ্ছে আমাদের। পরিবারের কী অবস্থা ভাবুন তো এক বার!”
বঙ্গোপসাগরে প্রায় চার দশক ধরে চলতে থাকা ভারত-বাংলাদেশ জল-সীমান্ত নিয়ে বিবাদ মিটেছে মাস পাঁচেক। চলতি বছর জুলাইয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই দেশের নতুন জল-সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছে। মৎস্যজীবীরা শুনেছেন, এত দিন ভারতের অধিকারে থাকা সাগরের বেশ কিছুটা এখন বাংলাদেশের ভাগে চলে গিয়েছে। কিন্তু কোথায় শেষ হচ্ছে ভারত, আর শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের জল তা নির্দিষ্ট করে মৎস্যজীবীরা জানেন না। না প্রশাসন, না তটরক্ষী, কেউই এ বিষয়ে তাঁদের সাহায্য করতে পারছে না। আর তা থেকেই এই সমস্যা।
প্রশাসন সূত্রের দাবি, রায় বেরোনোর পরেও সরকারি ভাবে নতুন সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ জারি হয়নি। সীমান্ত লঙ্ঘনের দায়ে গত তিন মাসে বাংলাদেশের তটরক্ষীদের হাতে বন্দি হয়েছেন ১৩২ জন মৎস্যজীবী। আটক হয়েছে অন্তত ১২টি ট্রলার। প্রায় দু’মাস বাংলাদেশে জেলের ভাত খাওয়ার পরে রবিবার ৫টি ট্রলার নিয়ে কাকদ্বীপে ফিরেছেন ৬৫ জন মৎস্যজীবী। ফিরে তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এফবি হীরালালের মৎস্যজীবী মাখন দাসের বাড়ি কাকদ্বীপের পূর্ব গঙ্গাধরপুরে। দু’মাস বাংলাদেশের জেলে কাটিয়ে রবিবার ফিরে তিনি বলেন, “কেঁদো দ্বীপ থেকে প্রায় ১৮ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ পূর্বে মাছ ধরছিলাম। সে সময় ওই দেশের তটরক্ষীরা এসে বললেন, তোরা এ দিকে এসেছিস কেন। আমরা বললাম, স্যার আমাদের তো ভারতীয় সীমার মধ্যেই মাছ ধরছি! কিন্তু সেই অফিসার ধমকে বললেন, চুপ কর। এর পরই আমাদের ধরে মঙ্গলা থানায় নিয়ে গিয়ে তোলা হল।”
নতুন রায় অনুযায়ী, ভারতের জল-সীমার শেষ বিন্দু কেঁদো দ্বীপ থেকে সোজা দক্ষিণে প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত গভীর সমুদ্র বাংলাদেশের আওতায় চলে গিয়েছে। জল-সীমান্ত বদলের আগে পর্যন্ত সেখানে ভারতীয় মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে যেতেন। মৎস্যজীবীদের দাবি, তাঁরা এই নতুন জল-সীমান্ত বুঝতে পারছেন না। তাঁদের সংগঠনের নেতা বিজনবাবু বলেন, “সরকারি তরফে নতুন নির্দেশ জারি হয়নি। ফলে, গভীর সমুদ্রের কোন এলাকায় যাওয়া যাবে, আর কোন এলাকা বাংলাদেশের, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না।”
ভারতের জল-সীমার মধ্যে জলযান চলাচলে নজরদারি করে দেশের উপকূলরক্ষী বাহিনী। জল-সীমান্ত সংক্রান্ত এই সমস্যার কথা মৎস্যজীবীরা ফ্রেজারগঞ্জে উপকূলরক্ষী বাহিনীর স্থানীয় কম্যান্ড্যান্টকে জানিয়েছেন। উপকূলরক্ষীদের তরফে গত ২২ নভেম্বর মৎস্যজীবীদের একটি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, কেঁদো দ্বীপের দিকে তাঁরা যেন আপাতত না যান। তবে কোথায়, কত দুর জলসীমার মধ্যে তাঁরা মাছ ধরতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি উপকূলরক্ষীরা। বাহিনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ডিআইজি ডি আর শর্মা বলেন, “নতুন জল-সীমান্তের ব্যাপারে কোনও নির্দেশ আমরাও পাইনি।”
বাংলাদেশের উপকূলরক্ষী বাহিনীর এক কর্তার কথায়, নতুন জলসীমান্ত নিয়ে বিভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই। দু’দেশ আপসে মেনে নিয়েছে এই সীমান্ত। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পরে দু’দেশের প্রতিনিধিরা সই করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমেও এই মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তার পরে সীমান্ত লঙ্ঘন হলে যা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, বাংলাদেশের তটরক্ষীরা সেটাই করছেন। ওই কর্তা বলেন, ভারতের মৎস্যজীবীদের উচিত নতুন মানচিত্র মেনে তাদের জলসীমাতেই মাছ ধরা। রাজ্য প্রশাসন তাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করুক। তা হলে আর এ নিয়ে কোনও মনোমালিন্য ঘটে না।
আশার কথা শোনাতে পারেনি রাজ্য প্রশাসনও। কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিত নাথ বলেন, “এই সমস্যা আমাদের নজরে আসার পরে ওই রায় সম্পর্কে কী করণীয়, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। মৎস্যজীবীদেরও বলা হয়েছে, তাঁরা যেন বিষয়টি নিয়ে মৎস্য দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেন।” তবে এ ব্যাপারে মৎস্য দফতরও হাত তুলে দিয়েছে। অতিরিক্ত মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সুরজিৎকুমার বাগ বলেন, “উপরমহল থেকে কোনও নির্দেশ আমাদের কাছে নেই।”
মৎস্য দফতর থেকে দাবি করা হয়েছে, গভীর সমুদ্রে নতুন জল-সীমান্ত চিহ্নিত করতে মৎস্যজীবীদের ট্রলারে থাকা জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) সেট-এর সাহায্য নিতে হবে। ওই যন্ত্রে নতুন জল-সীমান্তের দ্রাঘিমাংশ এবং অক্ষাংশ চিহ্নিত করে দিতে হবে। কোনও ভাবে ওই সীমান্ত অতিক্রম করলেই ট্রলারে বিপদ-সঙ্কেত বাজবে। কিন্তু সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা বলেন, “এটা আন্তর্জাতিক জল-সীমান্ত পরিবর্তনের ব্যাপার। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে নির্দেশ না এলে আমরা কিছুই করতে পারি না।” তাঁর দাবি, নতুন অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ কত, সেটা জানেন না তাঁরা। কিন্তু মৎস্যজীবীরা যখন এমন চরম বিপদে পড়ছেন, তখন রাজ্য সরকার কেন কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে জলসীমান্তের বিষয়টি পরিষ্কার করে জেনে নিচ্ছে না সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মন্ত্রী দিতে পারেননি।
মন্তব্য চালু নেই