অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে অটোরিকশা চালকদের যত ফন্দি
সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে নানান ফন্দির আশ্রয় নিচ্ছে। মিটারে না যাওয়া ও টেম্পারিং করা মিটারের মাধ্যমে বেশি ভাড়া আদায় এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।এক্ষেত্রে যাত্রীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করলে, কাগজপত্র দেখা ছাড়া পুলিশের কিছু করার থাকেনা বলে জানান ট্রাফিক কর্মকর্তারা। অন্যদিকে বিআরটিএ-এর কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক সমিতির নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন।
বৃহষ্পতিবার সকালে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড থেকে রমনা থানার পাশে মিন্টো রোডের পূর্ব মাথায় যাবে কিনা জানতে চাইলে পর পর পাঁচজন সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক যেতে রাজি হননি। দু’একজন যেতে চাইলেও আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা ভাড়া দাবি করেন। আরেকজন চালক মিটারে যেতে চাইলেও ৫০ টাকা অতিরিক্ত দাবি করেন। মিটার ঠিক আছে কিনা জানতে চাইলে গাড়ি চালিয়ে চলে যান ওই চালক। অপর সিএনজি চালক সিরাজ মিয়া বলেন, মিটারে গেলে তাদের ছেলে মেয়ের পেটে ভাত পড়বেনা ঠিকমতো। মালিকের ভাড়া দিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় তাতে সংসার চলেনা। ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার সার্ভিস নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনও দূরত্বে যাত্রী পরিবহন বাধ্যতামূলক হলেও এর ধারে-কাছেও নেই অটোরিকশা চালকরা।
ঢাকা জেলা ফোর স্ট্রোক অটোরিকশা ডাইভার্স ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘মিটার টেম্পারিং-এ অনেক ক্ষেত্রে মালিকরাও সহযোগিতা করেন।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়মানুযায়ী সারাদিনে একটি অটোরিকশার ভাড়া ৯০০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও, তারা দুই শিফটে ভাড়া দেন। এক্ষেত্রে ছয়শ’ থেকে আটশ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করেন মালিকরা। সারাদিনে ভাড়া নেন ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা। চালককে পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলে তারাও অনেক ক্ষেত্রে মিটার টেম্পারিং-এ সহযোগিতা করেন।’ ফারুক চৌধুরী আরও বলেন, ‘এছাড়া প্রাইভেট লেখা এবং ঢাকার পাশের জেলার কিছু অটোরিকশা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে রাজধানীতে চলাচল করে। যাদের অনেকেই ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত।’
একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমেদ বলেন, মিটার টেম্পারিং করে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে মাঝে-মধ্যে তারা অভিযোগ পান। কিছু গ্যারেজের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিশিয়ান দিয়ে মিটারের সার্কিট টেম্পারিং করা হয়।’ এ জন্য তারা তাদের সংগঠনভুক্ত চালকদের বলে দিয়েছেন এসব করলে তারা পাশে থাকবেন না। তাছাড়া এ বিষয়ে সাংগঠনিকভাবে তাদের কিছু করারও থাকেনা বলে জানান তিনি।
অটোরিকশা ডাইভার্স ইউনিয়নের অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর অটোরিকশা ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক খোকন পাশা বলেন, ‘অটোরিকশার কাগজপত্রে অনিয়ম হলে পুলিশ আছে। আর মিটার টেম্পারিং এর বিরুদ্ধে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। মালিকরা মিটার টেম্পারিং-এ জড়িত থাকার প্রশ্নই আসেনা। তবে সব জায়গাতেই দু’একজন খারাপ লোক থাকেন। তাদের জন্য আইনও আছে।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মিটারে না গিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও মিটার টেম্পারিং করে বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে তারা একাধিকবার বিআরটিএ এবং সিএনজি চালিত অটোরিকশা মালিকদের বলেছেন। কয়েকমাস আগে একটি গ্যারেজ মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়না। এসব সমস্যা সমাধানের কোনও জায়গা নেই বলে তিনি আক্ষেপ করেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এনেতা আরও জানান, গত জানুয়ারিতে রাজধানীতে তারা একটি জরিপ পরিচালনা করেছেন। সেই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, মিটারে চলাচলকারী অটোরিকশার ৮১ শতাংশ ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করছে। ৬২ ভাগ মিটারের বদলে চুক্তিতে চলাচল করছে। যাত্রীদের গন্তব্যে যেতে রাজি হয়না ৭৩ ভাগ অটোরিকশা।
বিআরটিএ-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, মিটার টেম্পারিং সহ যানবাহনগুলোর অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধেই নিয়মিত অভিযান চালান তারা। তিনি বলেন,‘ টেম্পারিং ধরতে পারলে ১০ হাজার টাকার নিচে জরিমানা করিনা। অনেক বড় জরিমানা করি। যাতে পরবর্তী তিন মাসে কোনও লাভ না করতে পারে। এছাড়া গাড়ি ডাম্পিং-এ দিয়ে দেই। যাতে ভবিষ্যতে কোনও চালক মিটার টেম্পারিং না করে।’
কিভাবে চালকরা মিটার টেম্পারিং করেন এবং সেটা কিভাবে আপনারা শনাক্ত করেন, জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরা দুভাবে বুঝতে পারি মিটার টেম্পারিং করা হয়েছে কিনা। মিটার সিল করা আছে কিনা সেটা দেখি। সিল করা থাকলে টেম্পারিং এর সুযোগ সাধারণত থাকে না। টেম্পারিং এর জন্য তারা সিল ভেঙে ফেলেন। আর সিল না থাকলেই তাদের শাস্তি ও জরিমানা করা হয়।’
লেগুনা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে বর্তমানে জোরদার অভিযান চলছে জানিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ‘মিটারে না গিয়ে কিংবা মিটার টেম্পারিং করে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কিনা সে বিষয়টির ওপরে জোর দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ছদ্মবেশে আমাদের লোক যাত্রী হিসেবে গিয়েও তাদের ধরে নিয়ে আসে। এরপর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আর লেগুনা ও মাইক্রোবাসের ক্ষেত্রে রুট পারমিট ও কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা সেটার ওপর জোর দেওয়া হয়।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আবু ইউছুফ বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্টে দাঁড় করিয়ে যাত্রীর কাছে ট্রাফিক সার্জেন্টরা জানতে চান, মিটার অনুযায়ী গন্তব্যে যাওয়া হচ্ছে কিনা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রী হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। তখন পুলিশ অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষার পর ছেড়ে দেন। টেম্পারিং এর বিষয়টি দেখা ট্রাফিক পুলিশের জন্য কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া এটি বিআরটিএ-র বিষয়।’ তিনি বলেন, তবে কেউ অভিযোগ করলে তারা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও মিটার টেম্পারিং এর বিষয়ে যাত্রীরা অভিযোগ না করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের কিছেই করার থাকেনা।-বাংলা ট্রিবিউন
মন্তব্য চালু নেই