অজ্ঞানপার্টির সঙ্গে জড়িত ওষুধ ব্যবসায়ীরাও

ছিনতাইয়ের কৌশল পাল্টে এখন তৎপরতা বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। এদের ব্যবহৃত রাসায়নিকে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। গত দুই মাসে রাজধানীতেই প্রাণ হারিয়েছে চারজন, তাদের দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গুলিস্তান থেকে উদ্ধারের পর ঢামেক হাসপাতালে মারা যান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা অফতাব উদ্দিন ফরাজী (৬৫)।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে ভয়ঙ্কর চিত্র। গত ছয় বছরে অজ্ঞানপার্টির শিকার তিন হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে এ সংখ্যা এক হাজার। মোট মৃত্যু ২৮।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টি ব্যবহার করে মারাত্মক ক্ষতিকর কিছু চেতনানাশক ওষুধ ও রাসায়নিক। এর মধ্যে আমদানি নিষিদ্ধ এটিভেন ট্যাবলেট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এপিট্রা নামে একটি তরল ওষুধও ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া মিডাজোলাম, নাইট্রাজিপাম, মাইলাম, ডর্মিকাম, মিলানসহ কয়েকটি ঘুমের ট্যাবলেট এবং ক্লোরোফম জাতীয় চেতনানাশকও ব্যবহার করে তারা। অপরদিকে মলম পার্টি বিষাক্ত মলম ও মরিচের গুঁড়া চোখে মেখে বা ছিটিয়ে দেয়।

তবে এইসব রাসায়নিক বা ওষুধপত্র তাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে কীভাবে? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর মিটফোর্ড, শেরে বাংলা নগর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শাহবাগ, গুলিস্তান, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ওষুধের দোকানে এসব দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অজ্ঞান পার্টির রয়েছে নিজস্ব বিক্রেতা ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ওষুধ প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।

কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে ৪০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে ৪০০ অজ্ঞান পার্টির সদস্য সক্রিয়। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে প্রায়ই নিষিদ্ধ ওষুধসহ অজ্ঞান পার্টির সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তবে গ্রেপ্তারদের সূত্র ধরে নিষিদ্ধ ওষুধ উদ্ধার করতে পারছে না গোয়েন্দারা।

চিকিৎসকরা বলছেন, গরম শুরুর আগেই রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়ে গেছে। সপ্তাহে গড়ে ৫০ জন ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার দারুস সালাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৪০ এটিভেন ট্যাবলেটসহ অজ্ঞান পার্টির সদস্য মাহাবুব শিকদার, মিজান সরদার, আনোয়ার হোসেন, জীবন, শাহিন ও মাসুদ শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদলটির প্রধান মাহবুব জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এটিভেন পায় তারা।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক হাজার পিস এটিভেনসহ গ্রেপ্তার ভুলু জ্ঞিাসাবাদে জানায়, তাদের ১২টি দলে পাঁচ-ছয়জন করে সদস্য। তারা সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই করে। পরে ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণে চালককে ফিরিয়ে দেয়। ভুলুর গ্রুপ এ পর্যন্ত শতাধিক অটোরিকশা ছিনতাই করেছে।

ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, ২৫ হাজার টাকায় সিন্ডিকেটের এক সদস্য ভুলুকে এক হাজার এটিভেন দিয়েছে। অন্য গ্রুপগুলোর কাছেও এমন ওষুধ আছে। কোথা থেকে ওষুধ আসছে তা বলেনি ভুলু। তবে মিরপুর এলাকার ফার্মিসিতে বিক্রি হয় বলে দাবি করছে। এসব সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করছি।

গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্য মতে, এটিভেন ট্যাবলেট খুব সহজেই তারা পায়। রাজধানীর মিটফোর্ড, শেরে বাংলা নগর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শাহবাগ, গুলিস্তান, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকার নির্দিষ্ট ফার্মেসি থেকে এ ট্যাবলেট সংগ্রহ করে চক্রগুলো। আগে পাকিস্তান থেকে এটিভেন আসলেও এখন ভারতের সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে। ভুলুর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ট্যাবলেটগুলো ভারতের।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত এক বছরে দলনেতা আবদুল গফুর, আব্দুর রাজ্জাক, রমজান আলী, নিয়ামুলসহ শতাধিক অজ্ঞান পার্টির সদস্য গ্রেপ্তার করা হলেও উলে­খযোগ্য পরিমাণ চেতনানাশক ওষুধ উদ্ধার করা যায়নি।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অজ্ঞান পার্টির চতুর সদস্যরা ধরা পড়লে ওষুধ যে দিয়েছে তাকে চিনে না বলে দাবি করে। আর এ কারণে দায়সারা তদন্ত করে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেই আমরা। গভীরে যাই না।’

তবে একাধিক সূত্র জানায়, ফকিরাপুলে এবং মোহাম্মদপুরে কয়েকজন ফার্মেসির মালিক অজ্ঞান পার্টির সিন্ডিকেটে জড়িত বলে ডিবির কাছে তথ্য আছে। গত বছরের ৮ জুলাই কালভার্ট রোডের গাউসিয়া ফার্মেসির মালিক আবুল বাশারসহ পাঁচ অজ্ঞান পার্টির সদস্যকে গ্রেপ্তার ডিবি। আব্দুল মতিন, সেলিম, শিমুল ও আবুল হোসেন নামের চারজন ডিবিকে জানায়, তারা বাশারের কাছ থেকে ওষুধ সংগ্রহ করত। তবে তাদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ চেতনানাশক উদ্ধার করা হয়েছিল।

২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি গ্রেপ্তারকৃত সাতজন জানায়, তারা কলেজগেটের ‘মেডিসিন কর্নার’ ফার্মেসি থেকে নিয়মিত এটিভেন কিনেছিল। পরে ডিবি ১ হাজার ৭১০ পিস এটিভেন ট্যাবলেটসহ ওই দোকানের মালিক ও কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে দোকান মালিক জানান, তারা মিটফোর্ড থেকে এটিভেন কিনে অজ্ঞান পার্টির কাছে সরবরাহ করে। তবে কিছুদিনের মধ্যে তারা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন বলে জানায় সূত্র।

সূত্রমতে, রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির ৪০টি গ্রুপে অন্তত ৪০০ সদস্য আছে। তাদের প্রায় সবাই-ই এখন জামিনে মুক্ত। দলনেতাদের মধ্যে- আহসান আলী, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, আব্দুল সালাম, শেখ আবু জাফর, জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ শহিদুল ইসলাম ওরফে বাবু, বোরহান শেখ, রফিজ শিকদার, মিন্টু শিকদার, শফিকুল সমাদার, মিল্টন শিকদার, হুমায়ুন, আনোয়ার হোসেন, এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, মাওলা, রিপন মৃধা, ফজলুর রহমান উলে­খযোগ্য। ডিবির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অনেক কৌশলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তার করে হত্যাচেষ্টা (৩০৭ ধারা), চেতনাহীন করা (ধারা-৩২৮) ও চুরির (ধারা-৩৭৯) মামলা দেওয়া হয়। তবে আদালত থেকে সহজেই তারা জামিনে বের হয়ে যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সব সময়ই নজরদারি করেছি। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বা নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রির বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়।’

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রির বিষয়ে দায়বদ্ধ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ‘ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। নিবন্ধন বাতিল হতে পারে, মামলাও হতে পারে। আমরা প্রায়ই অভিযান চালাই। তবে লোকবল সংকটের কারণে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।’

কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মনির হোসেন বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী অপকর্ম করে। তারা প্রভাবশালী বলেই হয়ত পারছে। কেউ যদি নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি করে তা বন্ধের দায়িত্ব আমাদের নয়। এর জন্য প্রশাসন আছে। প্রশাসনের নজরদারি থাকলে এমন হতে পরে না।’বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই