অগ্নিঝরা মার্চ : বাঙালি জাতির আত্ম পরিচয়ের দিন ১লা মার্চ

আজ থেকে শুরু হলো অগ্নিঝরা মার্চ মাস। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ বাঙালি জাতির আত্ম পরিচয়ের দিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের এদিনে বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিলো তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। মেতে উঠেছিলো নিজেদের স্বাধীকার আদায়ের রক্তঝরা সংগ্রামে। স্বাধীনতা অর্জনের হুশিয়ারী হুঙ্কার দিয়েছিলো স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি স্বৈরাচার শাসক শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দু মাত্রও দ্বিধা করেনি বীর বাঙালিরা। অকুতোভয়ে বাঙালিরা আত্ম পরিচয়ের সন্ধানে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগুতেছিলো বিজয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে। নিজেদের ন্যায অধিকার তথা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিদের অন্তরে ছিলোনা কোনো প্রকার ভয়ভীতি। ভয় ছিলোনা প্রতিপক্ষের নির্যাতন কিংবা মরণের। সকল প্রকার সংশয়-সংহার তোয়াকা না করে বাঙালিরা জান্তে চেয়েছিলো শুধু তাদের আত্ম পরিচয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আর ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ এ দুই প্রদেশে মিলে এক দেশ ছিলো। আমাদের দেশের নাম ছিলো ‘পূর্ব পাকিস্তান’। আর অপরটি ছিলো ‘পশ্চিম পাকিস্তান’। এ দুই প্রদেশের শাসন পরিচালনা করতো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসনকার্য থেকে শুরু করে নিমজ্জ্বিত-নিষ্পেসিত নিপিড়নের যাঁতাকলে সর্বোপরি বৈষ্যম্যে পৃষ্ট হয়ে দিনের পর দিন আসতেছিলো এদেশের খেটে খাওয়া শান্তি প্রিয় প্রতিটি মানুষ। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর যাঁতাকলের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে এদেশের বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের পেশাজীবীরা বিভিন্ন কৌশল খুঁজতে থাকেন। আর ভাবতে থাকেন কিভাবে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে পুরো পূর্ব-পাকিস্তানে বন্যার কারণে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন করে তারিখ ঘোষণা করা হয় ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ই ডিসেম্বর এবং বন্যা কবলিত এলাকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০টি আসনের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৯৭১সালের ১৭ই জানুয়ারি।

অপরদিকে, ১২ই নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘৃর্ণিঝড়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৫০ মাইল গতিসম্পন্ন ‘হ্যারিকেন’ নামের ওই ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ের দাপটে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তীব্র বেগে এক বেসরকারি হিসাব মতে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের প্রাণহানীসহ ৩০ লাখ মানুষের এক বিভীষিকাময় অমানবিক পরিসি’তিতে বেঁচে থাকার আর্ত মূহুর্তে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিধারুণ অবহেলা ও উদাসীনতা তাদের বিরুদ্ধে বাঙালির ঘৃণা-বোধ ও স্বাধীনমুখি একতা দিয়েছে সম্পূর্ণতা।

পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা ২৪ বছরের অপশাসন ও শোষনের কবল থেকে মুক্তির জন্য স্ব্বাধীকার অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয়বাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় করে। পরিষদের মহিলা আসনসহ মোট ৩শত ১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে জয় লাভ করে ১৬৭টি আসনে। অপরদিকে, প্রাদেশিক পরিষদের ৩শত ১০টি আসনের মধ্যে ২শত ৯৮টি আসনে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠাতা অজর্ন করেছিলো। ফলে তৎকালীন নির্বাচনে শর্ত অনুযায়ী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে দেশের মন্ত্রী পরিষদ গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ একচ্ছত্র অধিকার লাভ করে। নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত বিজয়ে ফেঁপে ওঠে পাকিস্তানের রাজ সিংহাসন। চমকে ওঠে পাকিস্তানি শাসকচক্র। বাঙালিদের একতা দেখে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শুরু করেছিলো শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার বানচালের ঘৃণ্য পাঁয়তারা।

১৯৭০ সালের ১২ই ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে পাকিস্তানি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পরিকল্পনা সামরিক সরকারের রয়েছে ‘নির্বাচন হচ্ছে তার প্রথম পর্যায় মাত্র। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এই জন্যই নব-নির্বাচিত প্রার্থীদের আমি স্বরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, জনগণ তাদের ভোট দিয়ে তাঁদের ওপর বিরাট আস্থা স্থাপন করেছে।

দেয়া-নেয়া ও সহনশীলতার ভিত্তিতে এখনই তাঁরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে যান, জাতি এখন তাঁদের কাছে তাই চাচ্ছে। জাতি তাঁদের ওপর যে আস্থা স্থাপন করেছে তাঁরা তা রক্ষা করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা সফল হোক এটাই কামনা করি।’

ভাষণটি একজন নিরপেক্ষ ও নিষ্ঠাবান প্রেসিডেন্টের উপযুক্ত বিবৃতি বলেই প্রতিয়মান। কিন্তু অন্যদিকে, দেশের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ৮৮টি আসনে বিজয়ী বিরোধী দল পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পিপলস পার্টি’ প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের লাহোরে এক জনসভায় বলেন যে, তাঁর দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই কাজ চালাতে পারবে না। তিনি আরো ঘোষণা দেন যে, জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলে বসে ক্ষমতায় না যান তাহলে পাকিস্তানি জনগণের মঙ্গলের জন্যে কাজ করার কেউ থাকবে না এবং ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের জন্যে কাজ করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি সব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও রায়কে ভ্রুকুটি করে তিনি বলেন যে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুই হলো পাকিস্তানে ক্ষমতার উৎস এবং কেন্দ্রস’ল; আর এই দুই প্রদেশেই তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এতএব তাকে ক্ষমতায় যেতই হবে।
১৯৭১সালের ১১ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং ১২ই জানুয়ারী কোনো সহকারী ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ১৩ই জনুয়ারী উভয় নেতা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোম্‌তাক আহমেদ, মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান উপসি’ত ছিলেন। ১৪ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বলেন যে, দেশের “ভাবী” প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা পুরোপরি সঠিক। এছাড়া ওই বৈঠকের ফলাফল সর্ম্পকে আর বেশী কিছু জানা যায়নি। ২৭শে জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন এবং ২৮শে জানুয়ারি তাঁর হোটেল কক্ষেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ৭০ মিনিটকাল আলাপ-আলোচনা করেন। ৩০শে জানুয়ারি দুই নেতার ৫ঘন্টা ব্যাপী নৌ-বিহারের পর ভুট্টো বলেন, ‘আমরা দু’নেতাই আলোচনায় সন’ষ্ট তবে আলোচনার দ্বার খোলা রইলো। অমীমাংসীত বিষয়গুলো আলোচনার জন্য আবার বৈঠক বসবে।’

অবশেষে ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন যে, ৩রা মার্চ বুধবার সকাল ৯ঘটিকায় ঢাকাস’ প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি জনাব ভুট্টো পেশোয়ারে এক বিবৃতিতে বলেন যে, ‘৬-দফার প্রশ্নে কোনো আপোস-মীমাংসার সম্ভাবনা না থাকায় তাঁর দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না। তবে ৬-দফার কোনো রদবদল বা আপোসের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে তারা যে কোনো দিন ঢাকায় আসবেন।’

ভুট্টোর ওই ঘোষণায় অনেক রাজনৈতিক নের্তৃবর্গ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি বেলুচ নেতা নবাব আকবর খান বুগ্‌তি এই মর্মে এক ঘোষণা দেন যে, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচাল করার জন্য জনাব ভুট্টো যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা পাকিস্তানের দু’ অংশকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যেই নেয়া হয়েছে।’
ওদিকে, ২৭শে ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের ৩৩জন নব-নির্বাচিত সদস্য ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে শুনা যায়। কিন্তু ভুট্টো পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার জোর দাবি জানান।নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ের পরও বাঙালিদের হাতে শাসন ক্ষমতার ভার ছেড়ে না দিয়ে বরং ক্ষমতাকে আকড়ে ধরে রাখার গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈরাচার শাসক গোষ্ঠী। আর সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তদানীন্তন পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন একাত্তরের ১লা মার্চ বেলা একটার সময় রেডিওতে আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর জোড়ে তুমুল হৈচৈ পড়ে যায়। অফিস-আদালত ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন মুক্তিকামী বাঙালিরা। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট খেলা মূহুর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার দর্শকবৃন্দ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে মাঠ পরিত্যাগ করে নেমে আসে রাস্তায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হল ত্যাগ করে।

অপরদিকে, মিছিলকারীদের বিক্ষোভে বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম মার্কেটের দোকানপাটসহ বন্ধ করে দেয় মাহাজনরা। ইয়াইয়ার ওই ঘোষণার মাধ্যমে সে মূর্হুতে একটি দেশকে পরিণত করা হয়েছিলো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে। ফলে পরিস্থিতি অনির্শ্চয়তার দিকে ক্রমেই ধাবমান হতে থাকে। যা ছিলো মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্খিত। একাত্তরের ১লা মার্চে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব জাদা ইয়াকুব আলী খাঁনকে কিছু শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁন। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো শর্ত মানতে রাজি হননি।

ফলে সাহেব জাদা ইয়াকুব আলী খান বঙ্গবন্ধুকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তানে কামান দাগানো হবে’ (গর্জে উঠবে)। ওই হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু টেবিল চাপড়ে গর্জে বলে উঠেন- ‘আপনি আমাকে কিছু করলেও সহ্য হবে, কিন’ বাংলা এবং বাঙালিদের ওপর কামান দাগানো হলে তার বদলা নেবো’। কোনো কথা না বলে সাহেব জাদা ইয়াকুব আলী খাঁন সোজা চলে যায় পাকিস্তানে।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানি জেনারেল ইয়া হিয়া খাঁনের সঙ্গে বাঙালিদের ওপর শাসন ভার ছেড়ে দেওয়ার বিষয়াদি নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভট্টো’র মধ্যকার বিভিন্ন আলোচনা চলছিলো। দিনের পর দিন চলছিলো ওই আলোচনা। কিন’ তাতে কোনো অগ্রগতি হচ্ছিলো না। সেই সময় বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালি বলেছিলেন, ‘মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যকার আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে না। কারণ আলোচনা চলছে দুই বন্ধির মধ্যে সবে মাত্র। একজন ইয়া হিয়া খাঁন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে বন্ধি, অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জনগণের হাতে বন্ধি।’ অপরদিকে, এসব নামমাত্র পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র আলোচনা থেকে বাঙালিদের পক্ষে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত হচ্ছিলো না। তবে মুক্তিকামী বাঙালি জনতারা অতি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনা থেকে কোনো সুফল আসবে না। এ সময় তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু খোঁজ খবর ঠিকই রাখতেন কোথায় কি হচ্ছে, কেমন আছেন মুক্তিকামী বাঙালিরা। কি বা তাদের সমস্যা। এ নিয়ে তিনি সব সময় চিন্তায় থাকতেন তিনি। আর ভাবতেন কিভাবে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মেজর জিয়াউর রহমান ওই সময় যতেষ্ট সিনিয়র সেনা অফিসার ছিলেন। তিনি বাঙালিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল অলম্বন করেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ যথাযথ রক্ষা করেন।
বিপুল সংখ্যাঘরিষ্ঠ আসনে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিজয় হলেও তাদের হাতে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। বরং ক্ষমতায় বসে অদৃশ্য শক্তির কবলে ফেলে দিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের হাতে জিম্মী রাখতে চায় মুক্তিকামী বাঙালিদের। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ইশ্‌তেহার অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান মন্ত্রী হওয়ার কথা; কিন্তু তাকে সেই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে মুক্তিপাগল বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিরা যে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়না এবং নিজেদের হাতেই যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এই বোধ বাঙালি অফিসার এবং সৈন্যদের মধ্যে ছিলো। মেজর জিয়াউর রহমানসহ বাঙালিরা অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন যে, স্বাধীনতার দাবিকে ধ্বংস করার জন্য “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে যে পাকিস্তানি পরিকল্পনা চলছিলা তার সঙ্গে পাকিস্তানি তৎকালীন লে.কর্ণেল জানজুয়া সম্পৃক্ত ছিলো।

১লা মার্চ থেকে গোড়া দেশের মতো চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। মার্চের প্রথম দিন থেকেই সেখানেও অবরোধ চলছিলো। স্বাধীনতার দাবি আদায়ের পক্ষে যেন মুক্তিপাগল বাঙালিরা আন্দোলন এমনকি কোনো প্রকার সংগ্রাম করতে না পারে সেই জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় বিভিন্ন স্থনে পরিকল্পিত ভাবে ব্যারিকেট তৈরি করে। সব ধরনের পাকিস্তানি ষড়যন্তকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ডাক দেন স্বাধীনতার পক্ষে অসহযোগ আন্দোলনের। শুধু অসহযোগ নয়, বঙ্গবন্ধু’র ডাকে স্বাধীকার আদায়ের লক্ষ্যে একাত্তরের এদিন বিদ্রোহে ফেঁটে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কলকারখানার শ্রমিক এবং আদালতের আইনজীবীগণসহ সর্বস্থরের মুক্তিকামী আপামর জনতা।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় হোটেল পূর্বাণীতে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন এবং বৈঠক করেন। সংক্ষিপ্ত হস্তান্তর বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ ঢাকায় হরতাল এবং ৩রা মার্চ বুধবার দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান। পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণাকল্পে ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালের ১লা মাচের্র দিনে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘প্রভাতী’ পত্রিকায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরিয়েছিল। এক. পহেলা মার্চের আগের দিন (রোববার) পিআইএ বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। তারা অধিকাংশই ওয়ালী-মুজাফফর ন্যাপের। দুই. রোববার বিকেলে ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, জনাব ভুট্টো তার দলের ৮৩ জন সংসদ সদস্য নিয়ে ঢাকায় আসতে চান। আমি যদি বলি ১৬০ জন সদস্য নিয়ে আমরা পশ্চিম স্থতি কি দাঁড়ায়? পরিষদের আলোচনায় না বসে আগে কী করে আমরা প্রতিশ্রুতি দেব যে ছয় দফা সংশোধন করা হবে? ছয় দফা এখন জনগণের সমপত্তি, তাদের নির্বাচনীর রায়। ব্যক্তিগত ভাবে এর সংশোধন বা পরিবর্তনের অধিকার আমার নেই। আসলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল করার প্রক্রিয়া চলছে। এ চক্রান্তঅব্যাহত থাকলে পরিণামে যা ঘটবে তার জন্য চক্রান্তকারীরাই দায়ী হবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন সদস্য ও নেতাকে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাদের প্রস্তাব গ্রহণের আশ্বাস দেয়া হলে তারা অধিবেশনে যোগ দেবেন বলে যে উক্তি করেছেন, তার উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেছেন, যদি একজন সদস্যও কোন ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দেন, তা গ্রহণ করা হবে। আমরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে অন্যায় কিছু করব না।

এর দু’দিন পরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। তাই বাংলাদেশে সবার মনে উদ্বেল প্রতীক্ষা। আশা ও আশঙ্কার মিশ্র অনুভূতি। শেষ পর্যন্ত জনাব ভুট্টো তার মত পাল্টাবেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখবেনথ এটাই বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা।

গতকাল সকাল ১০টার আগেই জানা জানি হয়ে গেল, দুপুর ১টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতারে ভাষণ দেবেন। কী নতুন কথা বলবেন তিনি? দুরু দুরু শঙ্কা, কমিপত বুকে সবাই অপেক্ষারত। দুপুর ১টায় বেতার ঘোষক বললেন, এবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু না। ইয়াহিয়ার কণ্ঠ নয়, প্রেসিডেন্টের ঘোষণা পাঠ করলেন অন্য একটি কণ্ঠ জাতীয় পরিষদের বৈঠক ৩ মার্চ বসবে না।

অনির্দিষ্টকালের জন্য স’গিত রইল। আশা ভঙ্গের বেদনায় সবাই স-ম্ভিত। তারপরই গর্জে উঠল সারা ঢাকা। স্টেডিয়ামের খেলা ভেঙে তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ দর্শক বেরিয়ে এলো রাস্তায়। ঢাকা হাইকোর্টের সামনে একটি স্টেট বাস অগ্নিদগ্ধ হলো। লাখো বিক্ষুব্ধ মানুষ সমাবেত হলো হোটেল পূর্বাণীর সামনে। সেখানে বিকেলে চারটায় শেখ মুজিবের সাংবাদিক সভা। শেখ সাহেব সাংবাদিক সভা শেষ করে সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন, জাতীয় পরিষদের বৈঠক স’গিত রাখা একটি চক্রানে-র পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। সংশ্লিষ্টদের মতামতকে উপেক্ষা করে সংখ্যালগিষ্ঠ দলের প্রতিটি নেতার দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে। এটি গণতন্ত্র নয়, স্বৈরতন্ত্র। এর প্রতিবাদে প্রথম কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরদিন ঢাকায়, তারপরের দিন সারাদেশে হরতাল পালিত হবে এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা হবে। এ সভায় ঘোষিত হবে আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি। শেখ মুজিব আরও বললেন, আগামী ৭ মার্চের মধ্যে যদি বর্তমান পরিসি’তির কোন পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তবে ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার জন্য তিনি দায়ী থাকবেন না। শেখ মুজিবের এ বক্তব্য সমর্থন করে নুরুল আমিন সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বললেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স’গিত রাখা অযৌক্তিক এবং দেশের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের পথে আবার বাধা সৃষ্টির চক্রান্ত।

পহেলা মার্চ আরও দুটি ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশের গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসান পদচ্যুত হলেন এবং সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান অসামরিক প্রশাসনেরও দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সামরিক প্রশাসনের ১১০নং সামরিক আইনের নির্দেশে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের আহ্বানে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার খবর ও ছবি ছাপা নিষিদ্ধ করা হলো।

(তথ্য সূত্র : * দৈনিক আমার দেশ, সমকাল, সংগ্রাম- ১লা মার্চ, ২০০৯। *এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী রচিত)। * সাপ্তাহিক উর্মিবাংলা- ১৫ ই আগষ্ট, ২০০৫। *দৈনিক সংবাদ-০১.০৩.১৩ ( দৈনিক প্রভাতী পত্রিকারর পকাশিত খবর)।

(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, সাবেক সহ-সম্পাদক দৈনিক সংবাদ)



মন্তব্য চালু নেই