৬৭ বছর পর ট্যানারিমুক্ত হাজারীবাগ
অবশেষে চিরচেনা সেই অস্বাস্থ্যকর আর দুর্গন্ধময় জগৎ থেকে মুক্তি মিলছে রাজধানীর হাজারীবাগবাসীর। বদলে যাচ্ছে সেখানকার জরাজীর্ণ চেহারা। হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্পের আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটল শনিবার (৭ এপ্রিল) থেকে। এর মধ্য দিয়ে হাজারীবাগ থেকে বিদায় নিল ৬৭ বছরের পুরনো ট্যানারি শিল্প।
এক যুগের টালবাহানা শেষে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ সব সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হয় হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প। দিনভর চলা সেই অভিযানের কোনো বিরোধিতাও করেনি চামড়া ব্যবসায়ীরা। ফলে বহুল প্রতীক্ষিত হাজারীবাগ ও বুড়িগঙ্গার দূষণ বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাভারের হেমায়েতপুরে হরিণধরা গ্রামে গড়ে উঠেছে নতুন ট্যানারিপল্লী। সেখানেই পুনর্বাসন চলছে চামড়া ব্যবসায়ীদের।
এদিকে, হাজারীবাগ ট্যানারিপল্লীর ৭০ বিঘা জায়গার ওপর পরিকল্পিতভাবে আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণের মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আধুনিকতায় মতিঝিল, গুলশানসহ অন্য সব বাণিজ্যিক এলাকাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ হলেও সাভারে গড়ে উঠা নতুন চামড়া শিল্পনগরী এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। ফলে চামড়া ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। সেখানকার ট্যানারিগুলোর কাজ শেষ হয়নি। একটি ট্যানারিতেও মেলেনি গ্যাস সংযোগ। শেষ হয়নি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরির কাজও।
গ্যাস না থাকায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রাথমিক ধাপ (ওয়েট ব্লু) শুরু হলেও পরের ধাপ ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদনে যেতে পারছেন না ট্যানারি মালিকরা। এ পরিস্থিতিতে মহাসংকটের মধ্যে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বন্ধ করায় রফতানি হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। শুধু ব্যবসায়ী নয়, বিপাকে পড়েছেন ৪০ হাজার ট্যানারি শ্রমিকও। সাভারে কর্মসংস্থানের পথ এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। সেখানে নেই তাদের আবাসনের ব্যবস্থা।
তাই হাজারীবাগে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় গত শনিবার থেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন চামড়া শ্রমিকরা। হাজারীবাগের এমবি ট্যানারির নিরাপত্তাকর্মী রমজান আলী বলেন, ৩২ বছর ধরে এই পেশায় তিনি কাজ করেন। এখন কর্মহীন হয়ে পড়বেন। সেখানে বসবাসরত শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের পানি ব্যবহারের সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ না থাকায় থাকতে হচ্ছে অন্ধকারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, চামড়া শিল্পের ইতিহাসে এমন দুঃখের দিন আর আসেনি। চামড়া খাত এখন মহাসংকটে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন, ব্যাংক ঋণ, কাঁচা চামড়া ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
ভুলুয়া ট্যানারির মালিক এম এ আউয়াল বলেন, সাভারে গ্যাস সংযোগ পেতে ডিমান্ড নোট দিয়েছেন। কিন্তু গ্যাস সংযোগ পাননি। এ কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে আরো তিন মাস লাগবে। কিন্তু ইতোমধ্যে তার ইতালি, চীন, জাপান ও কোরিয়ার ক্রেতাদের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে।
২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আর ২০০৩ সাল থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ফের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।
এরপর ট্যানারি মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ৬ মার্চ হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব সেবা সংযোগ বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আর ট্যানারিগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ১০ এপ্রিলের মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরকে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। গত শনিবার সব সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পরিবেশ অধিদফতর।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রইছউল আলম বলেন, ইতোমধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর সব সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এখন ট্যানারি মালিকদের সাভারের হরিণধরা চামড়া শিল্পনগরীতে যেতেই হবে। ইতোমধ্যে ৫০টির মতো ট্যানারি চলে গেছে। এদিকে, শনিবারের অভিযানে হাজারীবাগে ১৯৩টি পানির লাইন, ২২৪টি বিদ্যুৎ সংযোগ ও ৫৪টি তিতাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে ১২৩টি টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়।
৩১ কোটি টাকার জরিমানা মওকুফ : সময়মতো ট্যানারি স্থানান্তর না করায় এবং পরিবেশ দূষণের দায়ে ১৫৪ ট্যানারি মালিককে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন আদালত। গতকাল রোববার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জরিমানার সেই টাকা মওকুফের আদেশ দেন।
একইসঙ্গে ট্যানারি শ্রমিকদের পুনর্বাসনে প্রত্যেক ট্যানারি মালিককে ৫০ হাজার টাকা করে সরকারের কাছে জমা দিতে বলা হয়। হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার একদিন পর এই জরিমানা মওকুফ করে আদালত। অন্যদিকে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সাভারে স্থানান্তর হওয়া ট্যানারি কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেওয়ারও নির্দেশ দেয়।
বদলে যাচ্ছে হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লী : হাজারীবাগে বিলুপ্ত ট্যানারি পল্লীর ৭০ বিঘা জায়গার ওপর পরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। আধুনিকতার দিক থেকে মতিঝিল, গুলশানসহ অন্য সব বাণিজ্যিক এলাকাকেও ছাড়িয়ে যাবে এটি। শতভাগ নাগরিক সুবিধা সংবলিত একটি আদর্শ আবাসিক পল্লী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, হাজারীবাগের পরিত্যক্ত ট্যানারি পল্লীতে পরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক জোন গড়ে তোলা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি সম্মতি দিলেই স্থানান্তর শেষ হওয়া মাত্র জমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে। তবে সরকার ট্যানারির জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করবে, নাকি ব্যক্তি মালিকানার মাধ্যমে ছেড়ে দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়নি।
হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ’৫০-এর দশকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রথম ট্যানারি স্থাপনের মাধ্যমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু হয়। পরে তা অনুকূল পরিবেশের কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হাজারীবাগে ট্যানারিপল্লী করার অনুমোদন দেয়। একই সঙ্গে ট্যানারি গড়ে তোলার জন্য ৭০ বিঘা জমির ওপর ‘লে আউট প্লান’ চূড়ান্ত করা হয়।
২১টি ট্যানারি শিল্পের মাধ্যমে তখন এ ট্যানারিপল্লীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এদের কোনোটির আয়তন ন্যূনতম ১০ কাঠা থেকে সর্বোচ্চ দুই বিঘা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। শিল্পটি ’৭০-র দশকে জাতীয়করণ হয়। ’৮০-র দশকে তা বেসরকারিকরণ করা হয়। ’৯০-র দশকে শিল্পটির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা, যা একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পটিকেই স্থান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা এখন চলমান।
সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে ২০০ একর জমির ওপর চামড়া শিল্পনগরে ১৫৫টি ট্যানারি শিল্প-কারখানাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করছে বিসিক। সাভারে ইতোমধ্যে ৫০টির মতো ট্যানারি ওয়েট ব্লু চালু করেছে। এর পরের ধাপগুলোর জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও গ্যাসের অভাবে চালু করা যায়নি। কিছু ট্যানারি ভবন নির্মাণ শেষ করতে পারেনি। এ ছাড়া ৫১টি ট্যানারি সাভারে প্লট পায়নি বলে জানায় চামড়া খাতের সংগঠনগুলো। হাজারীবাগে ট্যানারিগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
মন্তব্য চালু নেই