হিন্দু হিসেবে গরুর মাংস খাওয়ার অধিকার চাই

দাদরিতে ঘরে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে হিন্দু উন্মত্তরা মোহাম্মদ আখলাককে হত্যায় করায় একজন গরুর মাংস ভক্ষণকারী হিন্দু হিসেবে আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ। আরো খারাপ হচ্ছে পিটিয়ে হত্যার পক্ষে বিজেপির রাজনীতিকদের সাফাইয়ের অপচেষ্টা। সংস্কৃতি মন্ত্রী মহেশ শর্মা দাবি করেছেন এটি ছিল একটি ‘দুর্ঘটনা’।

সাবেক এমএলএ (সংসদ সদস্য) নওয়াব সিং নগর বলেছেন, যারা প্রভাবশালী ঠাকুরদের অনুভূতিতে আঘাত করার দুঃসাহস দেখায় তাদের পরিণতিটাও বোঝা দরকার। তার দাবি, ১৫ বছরের কম বয়সী ‘নিষ্পাপ শিশুরা’ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। অনেক বিজেপি নেতা গরুর মাংস খাওয়ার জন্য মুসলমানদের দোষারোপ করছেন। বিচিত্রা তুমার মুসলিমের খুনিদের গ্রেপ্তার না চাইলেও গরু জবাইকারীদের গ্রেপ্তার দাবি করেছেন।

শ্রীচাঁদ শর্মা বলেছেন, মুসলিমরা হিন্দু সেন্টিমেন্টের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখালে সহিংসতা অনিবার্য। দুঃখিত, হত্যার পক্ষে এগুলো খোড়া অজুহাত। বাছুর জবাই করা হয়েছে বলে মন্দিরের একজন পুরোহিত ঘোষণা দেয়ার পরই দাদরিতে উন্মত্ত জনতার ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। পরে সেই পুরোহিত স্বীকার করেছেন যে দুজন হিন্দু যুবকের চাপে তিনি মিথ্যা ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। কাজেই এটা ছিল খুনিদের একটা পরিকল্পিত দাঙ্গা।

পুলিশ আবার আখলাকের বাড়িতে পাওয়া মাংস জব্দ করে তা গরুর না কি খাসির তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। কেন? তাতে কী আসে যায়। গরুর মাংস হলেও ওই উগ্ররা হত্যার জন্য দায়ী হবেন। গরুর মাংস খাওয়ার সব ধরনের আইনগত অধিকার মুসলমানদের আছে। যেমন আমিও খাই। বহু রাজ্যে গাভী জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বলদ ও মহিষ জবাই নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়নি। কোথাও গরু জবাই হলে তাতে গরু জবাইয়ের কোনো আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন হয়ে থাকলে হিন্দুরা পুলিশের কাছে প্রশ্ন করতে পারে। কিন্তু তা না করে তারা পিটিয়ে মানুষ মারছে। তারা খুনি দুর্বৃত্ত এবং সেভাবেই তাদের দেখা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি এ ধরনের ঘটনার নিন্দা করতে অস্বীকৃতি জানান তবে ধরে নেয়া হবে যে তিনি তাদের আশীর্বাদ দিচ্ছেন। হিন্দুরা গরু জবাইয়ের বিরোধিতা করে বলে যে দাবি করা হয় তা মিথ্যা। হ্যা, এখন গরুর মাংসের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ঐহিত্য রয়েছে তবে দলিত এবং উপজাতীয়রা সব সময়ই গরুর মাংস খায়। ‘দলিত সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে সস্তার আমিষের অন্যতম উৎস হচ্ছে গরুর মাংস,’ বলছিলেন দলিত আদিবাসী বহুজন এবং সংখ্যালঘু ছাত্র সমিতির সভাপতি মোহন দারাবাথ।

প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে এমনকি উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মনীঋষিরাও গরুর মাংস খেতেন। এ সম্পর্কে চটজলদি জানার জন্য নিরোধ চৌধুরীর ‘দা কনটেন্ট অব সার্স’ পড়তে পারেন। তিনি বলেছেন, ‘বেদায় বলা হয়েছে গাভীর প্রতি ভালোবাসা মানে হচ্ছে গরুর সম্ভাব্য সব রকমের বাণিজ্যিক ব্যবহার-যার মধ্যে অবশ্যই খাবারের জন্য গরু জবাইও রয়েছে।’ নিরোধ চৌধুরী লিখেছেন, গরু জবাইয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে দীর্ঘ বিতর্ক রয়েছে তবে তারা সহাবস্থান করছে- যেমনটা রয়েছে নিরামিষভোজী বা ভেজেটারিয়ানজম নিয়ে।

মহাভারতে বলা হয়েছে, ‘কোনো অজুহাত না দেখিয়েই একজন মহানুভব রাজা অতিথি আপ্যায়নের জন্য প্রতিদিন ২০১০০ গরু জবাই করতেন।’ অন্য একটি কাহিনী রয়েছে যে একজন রাজা এক ঋষি বা মহাজ্ঞানীকে আপ্যায়নের জন্য একটি গাভী জবাই করেন।

তবে অন্য একজন ঋষি এক পাপাচার বলে মন্তব্য করেন। প্রাচীন হিন্দুত্ববাদের মর্মকথা ছিল এ ধরনের মতভিন্নতা ও বিতর্ক। এটা কখনো অনড় ধর্ম ছিল না। যখনই ধর্মশাস্ত্র কাটাছেঁড়া শুরু হলো তখন থেকেই গরুর মাংস খাওয়া উঠে যেতে থাকল। তা সত্ত্বেও খ্রিস্টপর্বূ অষ্টম শতাব্দীতে লেখা ভববুতির বিখ্যাত নাটক উত্তরা-রমা চরিত্রে অযোধ্যায় সওদাহাতাকি এবং ধনধান্যের মধ্যে নিম্নোক্ত সংলাপ দেখতে পাওয়া যায়। ধনধান্য: তিনি মান্যবর ভাসিসতা ছাড়া আর কেউ নয়।

সওদাহাতাকি: সত্যিই তিনি ভাসিসতা। ধনধান্য: তাহলে আর কে? সওদাহাতাকি: আমি তো মনে করেছিলাম এটা একটা বাঘ অথবা হনুমান। ধনধান্য: লিখিতভাবে বলা হয়েছে যে দধি আর মধুর সাথে মাংস পরিবেশন করতে হবে। কাজেই অতিথি হিসেবে যেসব গুণী ব্রাহ্মণ এসেছেন তাদের বড় বলদ অথবা ছাগল দিতে হবে। ধর্মীয় আইনে এটাই বলা হয়েছে।

আজকের ভারতে এ ধরনের নাটক নিষিদ্ধ করা হবে এবং এর নাট্যকারকে হত্যার হুমকি দেয়া হবে। কিন্তু প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যে ভববুতিকে অত্যন্ত সম্মানজনক সাহিত্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সেখানে কোনো সেন্সরশিপ অথবা উগ্র জনতার পিটিয়ে হত্যার ভয় ছিল না। হিন্দু গুণ্ডাদের এই আধুনিক অসহিষ্ণুতা মহান হিন্দু ঐতিহ্যকে প্রত্যাখান করছে।

প্রাচীনকালে অচ্ছুত কিংবা উপজাতীয়দের হিন্দু হিসেবে গণ্য করা হতো না। ঊনিশ শতকের প্রথমদিকের আদমশুমারিতেও দলিত এবং উপজাতীয়দের হিন্দু হিসেবে দেখানো হতো না। কিন্তু আধুনিক হিন্দুত্ববাদে এই দুই গোষ্ঠীকে হিন্দুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাদের ওপর নির্মম নিপীড়ন চলছে। আমি পরিবর্তনের পক্ষে। তবে সেই পরিবর্তনে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে দলিত এবং উপজাতীয়রা সবসমই গরুর মাংস খেতেন।

মুক্তিকামী হিসেবে বিশ্বাস করি মুক্ত পছন্দে। আমি সবসময় প্রত্যেকের পছন্দমাফিক খাওয়ার পক্ষে সোচ্চার ছিলাম। প্রাচীন হিন্দুদের ভববুতিতে সমুজ্জ্বল ঐতিহ্য অনুসারে আমি গরুর মাংস খাওয়ার অধিকার দাবি করছি। একজন ব্রাহ্মণ হিসেবে আমি সানন্দে মনীষী ভাসিসতার পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।

এসএ আয়ার: স্বামীনাথ এ আঙ্কেলসারিয়া আয়ার (এসএ আয়ার) ইকোনমিক টাইমসের উপদেষ্টা সম্পাদক। তিনি বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন। তিনি ভারতের শীর্ষ অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া



মন্তব্য চালু নেই