কোনো দেশই পেলেন না তারা

আবদুল হামিদ (৬২) ও তার চাচা সোহবান আলী শেখ (৮২)। ১৯ বছর আগে সীমান্ত অতিক্রম করে কোচবিহারের বাংলাদেশের ছিটমহলে প্রবেশ করেন তারা। প্রায় ৭০ বছর পর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ইতিমধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে শুরু করেছেন। নিজের পছন্দমতো দেশের নাগরিক হতে পেরে উভয় দেশের ছিলমহলবাসীদের মধ্যে আজ বইছে বাঁধভাঙা আনন্দের ঢেউ।

ভারতের কোচবিহারের ছিটমহলগুলোর প্রায় ১৪ হাজার মানুষ যখন নাগরিকত্ব পেয়ে উল্লাসে মেতেছেন, তখন আবদুল হামিদ ও সোবহান শেখের পরিবার পড়েছেন আকুলপাথারে। তাদের ভবিষ্যতে কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই দুই পরিবারের সদস্যরা কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাননি। অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি তাদের নাম। বাংলাদেশ সরকারের চোখে তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’ আর ভারত সরকার বলছে ‘অনুপ্রবেশকারী’। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কোনো দেশের নাগরিকত্ব না পেয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন এ দুই বৃদ্ধ। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও চাপা হতাশা।

তারা কীভাবে এখানে আসলেন আর কেনইবা দুদেশের কেউই তাদের নাগরিকত্ব দিতে চায়নি তারই বর্ণনা দিলেন হতাশায় কাঁতর আবদুল হামিদ। তিনি দাবি করেন, ১৯ বছর আগে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১২ জওয়ান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ‘ভুল’ করে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশ রাইফেলের (বিডিআর) সদস্যদের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে পদপ্রদর্শক (গাইড) হিসেবে কাজ করেন তারা ও তাদের পরিবার। নিরাপদ এলাকায় দিয়ে ওই জওয়ানদের ভারতে পৌঁছে দেন তারা। পুরস্কার হিসেবে তাদের ভারতের মধ্যেকার ওই ছিটমহলে থাকার অনুমিত দেয় বিএসএফ সদস্যরা।

আবদুল হামিদ আরো দাবি করেন, পথ হারানো ওই বিএসএফ সদস্যদের বাঁচানোর জন্য তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ ভাবা হয়। আগেই নিজ বাসস্থল বাংলাদেশের মধ্যে থাকা শুতি কুরশা এলাকার ১৪২ নং ছিটমহলে ফিরে যেতে পারতাম। কিন্তু ‘শাস্তি’ হিসেবে আমাদের বাড়িঘর আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সেজন্যে এরপর থেকে কোচবিহারের শাহেবগঞ্জ ব্লকে বসবাস করে আসছি। এ জায়গাটি হিন্দুদের। তারা আমাদের মানবিক কারণে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন। আজ যদি তারা আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলেন, তাহলে আমাদের এখন যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।

তিনি আরো বলেন, তিনিসহ তার দুই ভাই, তিন বোন, চাচা শেখ সোবহান ও তার পরিবার সেই সময় সীমান্ত অতিক্রম করে। এই দুই পরিবারে এখন লোকসংখ্যা বেড়ে ৭৭-এ দাঁড়িয়েছে।

আবদুল হামিদ বলেন, এ ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশাসনের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটার বাস্তবায়ন হয়নি। আমার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে। তাদের সন্তানও হয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালের আদম শুমারিতে আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি মধ্যরাতে যে ছিটমহল বিনিময় হলো, সেখানেও বাংলাদেশ না ভারত, কোনো দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
তবে বাংলাদেশের নয় কোচবিহারের অন্য ছিটমহলবাসিন্দাদের মতো ভারতের নাগরিকত্ব পেতেই ইচ্ছুক বলে জানান তিনি। সোহবান আলী শেখ প্রায় শয্যাগত। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি তার হতাশার কথা তুলে ধরেন প্রতিবেদককে।

কোচ বিহারের এমপি রেনুকা সিনহা জানান, হামিদের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি আমার সঙ্গে যখন দেখা করেছিলেন, তখন আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং তিনি আমাকে নথিপত্র দেখিয়েছিলেন। এটা মানবিক একটি বিষয়। বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

‘তবে বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর’, জানান কোচবিহারের ম্যাজিস্ট্রেট পি উলগানাথান।

তথ্যসূত্র : দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।



মন্তব্য চালু নেই