সাংবাদিক মন্টু হত্যার চূড়ান্ত রায়

ইতিহাস গড়লো আপিল বিভাগ

দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু গাড়িচাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ। নানা চড়াই-উৎরায় পার করে দীর্য দুই যুগ পর এ রায় ঘোষণা করা হলো। রায়ে গাড়ির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার হাইকোর্টের রায় পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। পাশাপাশি ‘দায়ী’ কোম্পানি পেপসি কোলার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।

রোববার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ পূর্ণাঙ্গ রায়ে পুনর্নির্ধারণ করা হবে।

নিহত সাংবাদিক মন্টুর স্ত্রী অধ্যাপিকা রওশন আক্তারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান। আর ওই গাড়ির মালিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

রায় ঘোষণার পর অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতের আদেশে উল্লেখ করা হয়, সিভিল পিটিশন ডিসপোজড অব উইথ অবজারভেশন ইন রেসপেক্ট অব কোয়ান্টাম অব ড্যামেজ।’

দুই যুগের বেশি সময় আগে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পেপসি কোলা বহণকারী একটি মিনি ট্রাক উল্টো পথে এসে ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর কাকরাইলের আনন্দ ভবনের সামনে মোজাম্মেল হোসেন মন্টুকে চাপা দেয়। বাদশা মিয়া নামে কোম্পানির এক চালক গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।

১৩ দিন অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সাংবাদিক মন্টু। এ ঘটনায় তার স্ত্রী রওশন আক্তার ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা তৃতীয় সাব জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। নিম্ন আদালতে বিনা সম্মানিতে মামলাটির আইনজীবী ছিলেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত অ্যাডভোকেট আমিনুল হক।

সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ২০ মার্চ বিচারিক আদালত রায় দেন। রায়ে নিহত সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়।

কিন্তু চালকের ভুলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় না যুক্তি দেখিয়ে কোম্পানিটি হাইকোর্টে আপিল করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১০ সালের ১১ মে রায় দেন। রায়ে চালকের ভুলে কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া যায় বলে মত দেয়ার পাশাপাশি টাকার পরিমাণ কমিয়ে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮ টাকা নির্ধারণ করে দেন আদালত।

হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধেও কোম্পানিটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রোববার রায় দেন আপিল বিভাগ।

আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আপিল পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতে দেয়া রায়ের আইনগত দিক বহাল রেখেছেন। তবে ক্ষতিপূরণ পুনর্নির্ধারণ করবে আপিল বিভাগ। এর পরিমাণ কত হবে তা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।’

অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান বলেন, ‘চালকের ভুলে গাড়ির মালিককে অর্থদণ্ড দেয়ার রায় আমাদের দেশে আর হয়নি। এর রায় দেশে আইনের শাসনের জন্য একটি মাইলফলক।’

তিনি বলেন, ‘এ রায়ের ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় কারো ক্ষতি করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।’

নিহত সাংবাদিক মন্টুর সহধর্মিনী অধ্যাপিকা রওশন আক্তার রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় এ মামলা পরিচালনা করে আসছি। এই দীর্ঘ সময়ের ধৈর্য্যের ফসল আজকের এ রায়।’

তিনি জানান, যানবাহন আইন ভঙ্গ করে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে তার স্বামীর জীবনহানির ঘটনায় তিনি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। এ জাতীয় ঘটনায় দেশের নাগরিকরা এ রায়ে উপকৃত হবেন বলে তিনি মনে করেন।

মোজাম্মেল হোসেন মণ্টু ১৯৪৫ সালের ১৫ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে সকল জীবনের অধিকারী মরহুম মন্টু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সাংবাদিকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দৈনিক সংবাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর মৃত্যুকালীন পর্যন্ত তিনি সংবাদের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।



মন্তব্য চালু নেই